নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
একটু একটু করে বইতে শুরু করেছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হাওয়া। এর আগেই রাজনৈতিক মাঠে ছড়াচ্ছে উত্তাপ। তৃণমূলে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার, অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সহিংসতা এবং ‘টার্গেট কিলিংয়ে’র মতো ঘটনা ঘটছে। এতে দেশি অস্ত্রের পাশাপাশি ব্যবহার হচ্ছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। হতাহত হচ্ছেন নেতাকর্মী। সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জে যুবলীগ নেতা খায়রুল আলম জেম, কুমিল্লার দাউদকান্দিতে যুবলীগ নেতা জামাল হোসেন, লক্ষ্মীপুরে যুবলীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল নোমান ও ছাত্রলীগ নেতা রাকিব ইমাম হত্যার ঘটনা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে লক্ষ্মীপুরে জোড়া খুন এবং দাউদকান্দিতে জামাল হত্যায় ব্যবহার হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র। নির্বাচনের আগে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার শঙ্কা ছড়িয়েছে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীর মধ্যেও।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বলছে, জানুয়ারি থেকে এপ্রিল এই চার মাসে বিভিন্ন পর্যায়ের স্থানীয় নির্বাচনসহ রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ১২৭টি। এতে নিহত হয়েছেন সাতজন। আহত হন ১ হাজার ৭২৩ জন। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের পাঁচজন প্রাণ হারিয়েছেন।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অবৈধ অস্ত্র ও বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারের ওপর নজরদারি বাড়াচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। চিহ্নিত অস্ত্র কারবারি ছাড়াও নতুনভাবে কেউ অস্ত্র সরবরাহ করছে কিনা তার ওপর নজর রাখা হচ্ছে। পেশাদার কোনো কারবারি ভাড়ায় অস্ত্র সরবরাহ করছে কিনা এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, যশোরের বেনাপোল, সাতক্ষীরা, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন এলাকার সীমান্ত পথে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আসে চোরাকারবারিরা। এসব অস্ত্র ছড়িয়ে পড়ে দেশের নানা প্রান্তে। রাজনৈতিক আধিপত্য, চাঁদাবাজি, ছিনতাই-ডাকাতিসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহার হয় এসব অস্ত্র। মাঝেমধ্যে কিছু অস্ত্র ধরা পড়লেও বেশিরভাগ থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। অনেক সময় মাদক কারবারিদের কাছেও মিলছে অস্ত্র। শুক্রবার টেকনাফের বাহারছড়ায় দেশি-বিদেশি ২৩টি অস্ত্রসহ অপহরণকারী ও ডাকাত চক্রকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
৩০ এপ্রিল রাতে কুমিল্লার দাউদকান্দির গৌরীপুরে যুবলীগ নেতা জামাল হোসেনকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। খুনিরা বোরকা পরে এসে তাঁকে গুলি করে। তিনি তিতাস উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। আধিপত্য বিস্তার ও পূর্বশত্রুতার জেরে জামাল খুন হয়েছেন বলে জানিয়েছেন র্যাব-১১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল তানভীর মাহমুদ পাশা।
হত্যার ঘটনায় নিহতের স্ত্রী পপি আক্তার বাদী হয়ে দাউদকান্দি থানায় হত্যা মামলা করেন। এতে জিয়ারকান্দি গ্রামের বাসিন্দা সুজন, আরিফ, ইসমাইল, সোহেল শিকদার, বাদল, শাকিল, শাহ আলম, অলি হাসান ও কালা মনিরকে আসামি করা হয়েছে। নিহত জামাল ২০১৬ সালের নভেম্বরে একই এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান ও যুবলীগ নেতা মনির হোসাইনের অনুসারী ছিলেন। মনির হত্যা মামলা তুলে নেওয়ার জন্য আসামিরা তখন থেকে জামালকে চাপ দিয়ে আসছিল। মামলা তুলে না নেওয়ায় সোহেল শিকদারসহ তার বাহিনী জামালকে হত্যা করেছে বলে নিহতের পরিবারের অভিযোগ।
গত ১৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহরের উদয়ন মোড়ে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় যুবলীগ নেতা খায়রুল আলম জেমকে। তিনি শিবগঞ্জ পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও জেলা যুবলীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। নিহত খায়রুল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও চাঁপাইনবাগঞ্জ-৩ আসনের এমপি আব্দুল ওদুদ বিশ্বাসের ঘনিষ্ঠ অনুসারী।
জেম হত্যার ঘটনায় তাঁর ভাই মনিরুর ইসলাম বাদী হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানায় মামলা করেন। এতে মেয়র মোখলেসুর রহমান, জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি সামিউল হক লিটন, মেসবাউল হক টুটুলসহ ৪৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। এই পর্যন্ত কৃষক লীগ নেতা মেসবাউল হক টুটুলসহ ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। খায়রুল হত্যার আগে ৯ এপ্রিল ওদুদের আরেক অনুসারী মনিরুল ইসলামকে সদর উপজেলার সুন্দরপুরে একই কায়দায় হত্যা করা হয়।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, ইউপি নির্বাচনে সৃষ্ট দ্বন্দ্বের জেরে লক্ষ্মীপুরে যুবলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান এবং ছাত্রলীগ নেতা রাকিব ইমামকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২৫ এপ্রিল রাতে সদর উপজেলার বশিকপুর ইউনিয়নের নাগেরহাট সড়কে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। নিহত নোমান জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং রাকিব জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। জোড়া খুনের মামলার প্রধান আসামি চন্দ্রগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবুল কাশেম জিহাদী। ফয়সালের ভাই জিতু দেওয়ান ২০২১ সালের জানুয়ারিতে রামগঞ্জ পৌরসভায় কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করেন। নোমান তাঁর ভাইয়ের বিপক্ষে থাকায় জিতু পরাজিত হন। এতে নোমানের ওপর ক্ষোভ ছিল ফয়সালের।
লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি গোলাম ফারুক পিংকু সমকালকে বলেন, ‘এলাকায় রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার এবং ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। ভবিষ্যতে যাতে দলের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, সে ব্যাপারে আমরা সজাগ আছি।’
নিহত আবদুল্লাহ আল নোমান বশিকপুর ইউপি চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমানের ভাই। ৪-৫ মাস আগে অনুষ্ঠিত ওই ইউপি নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জয়ী হন আওয়ামী লীগকর্মী মাহফুজুর। অপরদিকে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী চন্দ্রঘর থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবুল কাশেম জিহাদী পরাজিত হন। নোমান নৌকা প্রার্থীর বিপক্ষে আপন ভাই মাহফুজুর রহমানকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেন। দলীয় মনোনীত প্রার্থী কাশেমের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা না চালিয়ে ভাইয়ের হয়ে মাঠে নামেন তিনি। তাঁর অনুসারী ছাত্রলীগ নেতা রাকিব ইমামও মাহফুজুরের পক্ষে কাজ করেন। এ ছাড়া নোমানের অনুসারী যুবলীগের নেতাকর্মীরা নির্বাচনে তাঁর ভাইয়ের পক্ষে প্রচারণা চালান। মাহফুজুর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর রাকিব ইমামকে ইউপির উদ্যোক্তা পদে চাকরি দেওয়া হয়। এসব দ্বন্দ্বে নোমান ও রাকিবকে হত্যা করা হয়েছে বলে তদন্ত সূত্র জানিয়েছে।
সুনামগঞ্জের ছাতকে দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন হয়েছেন যুবলীগ নেতা লায়েক মিয়া। ২৮ মার্চ ছাতক শহরের খেয়াঘাটে ছুরিকাঘাতে তাঁকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় দায়ের মামলার প্রধান আসামি স্থানীয় যুবলীগের কর্মী আব্দুল কুদ্দুস শিপলু। ২ নম্বর আসামি ছাতক পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আওয়ামী লীগ নেতা তাপস চৌধুরী।
২৩ এপ্রিল রাতে রাজবাড়ীর ছাত্রলীগ নেতা সুমন শেখ সবুজকে গুলি করে হত্যা করা হয়। জেলার বরাট ইউনিয়নের উড়াকান্দা গ্রামে নিজের বাসায় সহযোগীদের নিয়ে ব্যবসায়িক হিসাব করছিলেন তিনি। তখন ৩০-৩৫ জন ওই বাড়িতে হামলা চালায়। জানালা দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় সবুজকে। একই ঘটনায় সবুজের সহযোগী সজীব সরদার গুলিবিদ্ধ হন।
পুলিশ বলছে, দলীয় স্থানীয় নেতাকর্মীর সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জেরে প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত হন সবুজ। সবুজ রাজবাড়ী সদর উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক এবং বরাট ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। তাঁর বাড়ি একই ইউনিয়নের উড়াকান্দা গ্রামে।
সবুজের খেলনার সরঞ্জামের ব্যবসা ছিল। একই এলাকার গোলাম মোস্তফা, সাইফুল, রুবেলসহ কয়েকজন রিসোর্টে খেলনার সরঞ্জাম বসানোর চেষ্টা করলে সবুজ বাধা দেন। এ নিয়ে তাঁদের সঙ্গে রুবেলের দ্বন্দ্ব ছিল। এছাড়া বরাট ইউনিয়ন যুবলীগের কাউন্সিল সম্পন্ন হয় কয়েক মাস আগে। কাউন্সিল অনুষ্ঠানের অদূরে রুবেলের সঙ্গে তুচ্ছ ঘটনায় সবুজের তর্ক বাধে। এক পর্যায়ে সবুজ তাঁকে ধাওয়া করে। এ নিয়েও বিরোধ চলছিল। এ দুটি কারণে সবুজকে হত্যা করা হতে পারে বলে পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছে।
২ মে বরগুনায় ইউপি নির্বাচন নিয়ে বিরোধ ও দলীয় আধিপত্যকে কেন্দ্র করে সদর উপজেলার আয়লা-পাতাকাটা ইউনিয়নের পাকুরগাছিয়া গ্রামে দু’পক্ষের সংঘর্ষ হয়। এতে প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে খুন হন সাবেক ইউপি সদস্য শফিকুল ইসলাম। তিনি আয়লা-পাতাকাটা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২৪ এপ্রিল রংপুরের কাউনিয়ায় আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষে সোনা মিয়া নামে এক কর্মী প্রাণ হারান।