নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
সীমান্তের বিভিন্ন এলাকা দিয়ে দেশে ঢুকছে ক্রিস্টাল মেথ বা আইসের ছোট-বড় চালান। হাত ঘুরে অধিকাংশ চালান পৌঁছে ঢাকায়। এরপর পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের মাধ্যমে তা মাদকসেবীদের কাছে যায়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে অন্তত একশ আইস কারবারি রয়েছে। সমকালের তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, তাদের মধ্যে জনপ্রতিনিধি ও বিত্তশালী ব্যবসায়ীদের সন্তানও আছে। এ ছাড়া বিদেশপড়ুয়া ছাত্রছাত্রীও এই কারবারে জড়িত।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দিন দিন মাদক কারবারিরা নতুন নতুন মাদকের দিকে ঝুঁকছে। দুটি নতুন মাদক তরুণ সমাজের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। একটি হলো আইস, আরেকটি লাইসার্জিক এসিড ডাইথ্যালামাইড বা এলএসডি। এ দুটি মাদক আলোচনায় আসে ২০১৯ সালে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), কোস্টগার্ড, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযানে মাঝেমধ্যে চালান ধরা পড়ার ঘটনা প্রমাণ করে– দেশে আইসের বাজার বড় হচ্ছে।
গত ২৬ এপ্রিল বিজিবির হাতে কক্সবাজারে আইসের সবচেয়ে বড় চালান ধরা পড়েছে। এদিন ২১ কেজি ৯০ গ্রাম আইস জব্দ করা হয়। গ্রেপ্তার হয় তিন কারবারি। আইস সম্পর্কে কোনো গবেষণা নেই মাদক নিয়ন্ত্রণে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি)। এটি দেশে কীভাবে ঢুকল, বাজার সৃষ্টি করছে কারা, তরুণ-তরুণী কেন আইসের দিকে ঝুঁকছে– এসব নিয়ে দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম নেই। নির্দিষ্ট কোনো তালিকাও নেই এই দপ্তরের কাছে। তবে বিভিন্ন সময় ঢাকায় যেসব আইস বিক্রেতা গ্রেপ্তার হয়েছে, তাদের তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
ডিএনসির পরিচালক (অপারেশনস ও গোয়েন্দা) তানভীর মমতাজ সমকালকে বলেন, আইস কারবারিদের নির্দিষ্ট কোনো তালিকা নেই। তবে কারা, কোন পথে, কীভাবে আইস আনছে– সেসব বিষয় জানতে গোয়েন্দা কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
আইস অত্যন্ত ক্ষতিকর মাদক। এতে মিথাইল অ্যামফিটামিন থাকে ৯৬ শতাংশ, যা ইয়াবার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। অল্পমাত্রায় আইস সেবন করলে বেশিমাত্রায় আসক্তি সৃষ্টি হয়। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মস্তিষ্ক। লিভার, কিডনি, দৃষ্টিশক্তি, স্বাভাবিক চিন্তাশক্তি, শ্রবণশক্তি, চেতনাশক্তি, স্মৃতিশক্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আইস সেবনে। প্রথমদিকে শুধু অভিজাত পরিবারের সন্তানরা আইস ব্যবহার করত। কারণ, এটি উচ্চমূল্যের মাদক। তবে চাহিদা থাকায় সরবরাহ যেমন বাড়ছে, তেমনি মূল্যও প্রথম দিকের চেয়ে একটু কমেছে। এ কারণে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও আইসের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ঢাকায় এর ব্যবহার বেশি।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় শতাধিক কারবারি আইস কারবার নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের মধ্যে রয়েছে– রাসেল ওরফে ভাতিজা রাসেল ও তার স্ত্রী রুমানা, জসিম উদ্দিন, চন্দন রায়, রামিসা সিমরান ওরফে ইডেন ডি সিলভা, রুবায়েত, মোহাইমিনুল ইসলাম ইভান, রোহিত, খবির, সারা, লাবণ্য, আলভী জাবরান তানহা, ফয়সাল, সিলেটি জালাল, পান মাসুদ, বাবর, থমাস, জাবের খান, তারেক আহম্মেদ, প্রিয়াঙ্কা মতিন, সৈয়দ আরিফুল ইসলাম, অপু, সুহৃদ, ল্যাংড়া জালাল, ফতেহ, ক্যাম্প কালু, রবিন, হুন্ডা জামাল, জিয়া, রুমি, আলকী উকিল, সাগর, নাইম, ফাহান, নুসরাত, রিফাত রহমান ওরফে রোদেলা, হাবিবুর রহমান ওরফে টিপু হাবিব, সিরাতন, জনি, জান্নাত, মিলিসা, রাসেল রাজু, সুজা কেনি, সৈয়দা আনিকা জামান ওরফে অর্পিতা জামান, লায়লা আফরোজ প্রিয়া, ইফাজ সুলতানা, সামওয়া আকবর খান সায়েম, আল আমিন, আমিনুল ইসলাম, নাজমুল, ফিরোজ, খোকন, মাহির, সাইফুল, রাকিব বাসার, ঝাক্কি রুদ্র, মেহেদি জামিরুল, তৌফিক, আপেল ইসলাম, খালেদ ইকবাল, ফারুক ওরফে হাড্ডি ফারুক, বাবু মিয়া ওরফে সোলেমান, তরঙ্গ জোসেফ কস্তা, মাসওয়া আকবর খান সায়েম, আমান উল্লাহ, নুসরাত জাহান পাপিয়া, জামাল হোসেন, সামসুল হুদা রিংকু, আশরাফুল আলম সিহাদ, নাসিম হাসান ওরফে জামি, ওয়াহিদ শফিক, আমিন, আমিনুর ইসলাম, শাহবাজ হাসান আরাক, কাউসার হোসেন, মুন্না, মামুন, আজাদুল ইসলাম রাজা, সোয়েব খান, মরিয়ম বেগম ওরফে সুমি, শহীদুল ইসলাম খান, জহিরুল ইসলাম সুমন, নূরুল ইসলাম, মেজবাহ উদ্দিন ইমন, শিপন, মাসুম হান্নান, তানজিম আলী শাহ, হাসিবুল ইসলাম, আরাফা আক্তার, সাইফুল্লাহ সুমন ও খোশবার আলী। তারা বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার হয়েছে। তাদের কেউ কেউ কারাগারে রয়েছে এখনও।
এই কারবারিদের বসবাস ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। অভিজাত এলাকা গুলশান, বারিধারা, বনানী, উত্তরা ও ধানমন্ডিতে আইস কেনাবেচা হয় বেশি। অনেক কারবারি নিজেও সেবনকারী। তাদের কেউ কেউ ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। পড়ালেখাও করেছে দেশের বাইরে। তাদের মধ্যে রামিসা সিমরান ওরফে ইডেন ডি সিলভার বাবা চট্টগ্রামের বড় ব্যবসায়ী। রামিসা পড়ালেখা করেছে ভারতে। সে থাকে ঢাকায়। আইসের অন্যতম বড় কারবারি ভাইস্তা রাসেলের সহযোগী রামিসা। সে আইসসহ গ্রেপ্তারও হয়েছে। রাসেলের স্ত্রী রুমানা স্বামীর সঙ্গে আইস কারবারে জড়িত। তারা মাদক সরবরাহ করে গুলশান, ভাটারা ও বনানী থানা এলাকায়।
ভাতিজা রাসেল সিদ্ধেশ্বরী কলেজে অধ্যয়নকালে ভিপি ছিল। প্রভাবশালী এক সন্ত্রাসী তাকে ভাতিজা বলে ডাকত। এ থেকেই রাসেলের নামের আগে ভাতিজা যুক্ত হয়। কেউ কেউ ভাইস্তে রাসেল ডাকে। আইস জগতে রাসেল নামে পরিচিত সে। একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছে। বর্তমানে কারাগারে আছে। এখন তার স্ত্রীসহ সহযোগীরা কারবার নিয়ন্ত্রণ করছে। বনানী, গুলশান ও ভাটারা এলাকায় আইসের ‘পার্টি আয়োজনে’ সহায়তা করে তার অন্যতম সহযোগী রামিসা। রামিসার টার্গেট ধনাঢ্য ঘরের তরুণ-তরুণী। ওই পার্টিতে বেশি দামে আইস বিক্রি করা হয়। আরেক আইস কারবারি রুবায়েত পড়ালেখা করেছে ইংল্যান্ডে। বনানী ও গুলশান এলাকায় আইস সরবরাহ করে সে। তার বাবাও বড় ব্যবসায়ী। তিনবার আইসসহ ডিএনসির হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে। এরপরও এই পথ থেকে ফিরে আসেনি।
আইস কারবারি মোহাইমিনুল ইসলাম ইভানের বাসা বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়। তার বাবা ঠিকাদার। নিজেদের দামি গাড়িতে চলাফেরা করে ইভান। আইসসহ দুবার গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগ করলেও কারবার ছাড়েনি সে। মধ্যরাতে আইস সেবন করে গাড়ি রেসিংও করে।
রোহিত বাড্ডার সাঁতারকুল এলাকার সাবেক এক ইউপি চেয়ারম্যানের ছেলে। সে পড়ালেখা করেছে মালয়েশিয়ায়। কুড়িল বিশ্বরোডের জোয়ার সাহারার জসিম উদ্দিনের দুটি বহুতল বাড়ি রয়েছে। ২০২১ সালে ২৬০ গ্রাম আইসসহ ডিএনসির হাতে গ্রেপ্তার হয়। ওয়ারীর চন্দন রায় ঢাকার অন্যতম আইস কারবারি। বিভিন্ন এলাকায় পাইকারি বিক্রি করে সে। টেকনাফ থেকে সরাসরি লোকজন দিয়ে আইস আনে ঢাকায়। ২০২২ সালের নভেম্বরে ডিএনসির হাতে ৫০০ গ্রাম আইসসহ গ্রেপ্তার হয় সে। খিলগাঁওয়ের মাসওয়া আকবর সায়েম গত বছরের ৪০৫ গ্রাম ইয়াবাসহ একই সংস্থার হাতে গ্রেপ্তার হয়।