আল্লাহর কুদরতের দুই নিদর্শন ‘নারী ও পুরুষ

আল্লাহর কুদরতের দুই নিদর্শন ‘নারী ও পুরুষ

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

নামাজ প্রতিষ্ঠার নির্দেশে শুরু হবে ১৪৪৪ হিজরির ১৮তম তারাবিহ। আজ সুরা আনকাবুতের ৪৫ আয়াত থেকে শেষ (৬৯) পর্যন্ত, সুরা রুম, সুরা লোকমান, সুরা সাজদা এবং সুরা আহযাবের প্রথম ৩০ আয়াত পড়া হবে। কোরআন অধ্যয়ন ও অশ্লীল-গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকতে আহ্বান করা হবে আজ। পড়া হবে ২১তম পারা। এ পারার শেষ দিকে বিশ্বনবির আদর্শ অনুসরণের ঘোষণা এসেছে। যে আদর্শ অনুসরণে সফল হবে মুমিন। আল্লাহ তাআলা বলেন-

لَقَدۡ کَانَ لَکُمۡ فِیۡ رَسُوۡلِ اللّٰهِ اُسۡوَۃٌ حَسَنَۃٌ لِّمَنۡ کَانَ یَرۡجُوا اللّٰهَ وَ الۡیَوۡمَ الۡاٰخِرَ وَ ذَکَرَ اللّٰهَ کَثِیۡرًا

যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসুলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম নমুনা।’ (সুরা আহযাব: আয়াত ২১)

সুরা আনকাবুত : ০১-৪৪

মক্কায় অবতীর্ণ সুরা আনকাবুত মুশরিকদের প্রতি ছিল এক বিশেষ চ্যালেঞ্জ। এ সুরায় আল্লাহ তাআলা মাকড়শার দৃষ্টান্ত দিয়ে শিরকের বাতুলতা প্রকাশ করেছেন। সংক্ষেপে এ সুরার আলোচ্যসূচি তুলে ধরা হলো-

আজকের তারাবিহের শুরতে কোরআন পাঠ ও নামাজ প্রতিষ্ঠার আহ্বান এসেছে। নামাজ প্রতিষ্ঠা হলেই বন্ধ হবে অশ্লীল ও গর্হিত কাজ। আল্লাহ তাআলা বলেন-

اُتۡلُ مَاۤ اُوۡحِیَ اِلَیۡکَ مِنَ الۡکِتٰبِ وَ اَقِمِ الصَّلٰوۃَ ؕ اِنَّ الصَّلٰوۃَ تَنۡهٰی عَنِ الۡفَحۡشَآءِ وَ الۡمُنۡکَرِ ؕ وَ لَذِکۡرُ اللّٰهِ اَکۡبَرُ ؕ وَ اللّٰهُ یَعۡلَمُ مَا تَصۡنَعُوۡنَ

(হে রাসুল!) আপনি আপনার প্রতি নাজিল হওয়া কিতাব পাঠ করুন এবং নামাজ প্রতিষ্ঠা করুন। নিশ্চয় নামাজ অশ্লীল ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখে। আল্লাহর স্মরণ সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ জানেন তোমরা যা কর।’ (সুরা আনকাবুত : আয়াত ৪৫)

আপাত দৃষ্টিতে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করা হয়েছে কিন্তু প্রকৃত পক্ষে সব মুসলিমকেই উদ্দেশ্য করা হয়েছে। এতে দুটি অংশ আছে, এক. কোরআন তেলাওয়াত, দুই. নামাজ প্রতিষ্ঠা করা। কারণ এ দুটি জিনিসই মুমিনকে এমন সুগঠিত চরিত্র ও উন্নতর যোগ্যতার অধিকারী করে। যার সাহায্যে সে বাতিলের প্রবল বন্যা এবং দুস্কৃতির ভয়াবহ ঝঞ্ঝার মোকাবিলায় সঠিক পথে থাকতে পারে।’ (আত-তাহরির ওয়াত তানওয়ির)

কোরআন তেলাওয়াতের এ শক্তি মানুষ তখনই অর্জন করতে পারে যখন সে কোরআনের শুধু শব্দগুলো পাঠ করেই ক্ষান্ত হয় না বরং তার শিক্ষাগুলোও সঠিকভাবে অনুধাবন করে হৃদয়ের প্রতিটি তন্ত্রীতে সেগুলোকে সঞ্চারিত করে যেতে থাকে। যে তেলাওয়াতের পরে মানুষের মন-মানস, চিন্তা-চেতনা ও চরিত্র-কর্মনীতিতে কোনো পরিবর্তন আসে না বরং কোরআন পড়ার পরও কোরআন যা নিষেধ করে মানুষ তা সব করে যেতে থাকে তা একজন মুমিনের কোরআন তেলাওয়াত হতেই পারে না। মূলত: কোরআনের হারামকৃত জিনিসকে যে হালাল করে নিয়েছে যে কোরআনের প্রতি ঈমানই আনেনি। এ অবস্থাটিকে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি ছোট্ট বাক্যের মধ্য দিয়ে অত্যন্ত চমৎকারভাবে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন-

কোরআন তোমার পক্ষে বা বিপক্ষে প্রমাণ স্বরূপ।’ (মুসলিম ২২৩)

কোরআন তেলাওয়াতের পর এখানে দ্বিতীয় যে কাজটির প্রতি উম্মতকে অনুবর্তী করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাহলো- নামাজ৷ নামাজকে অন্যান্য ফরজ কর্ম থেকে পৃথক করার এই রহস্যও বর্ণিত হয়েছে যে, নামাজ স্বকীয়ভাবেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং দ্বীনের স্তম্ভ। এর উপকারিতা এই যে, যে ব্যক্তি নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, নামাজ তাকে অশ্লীল ও গৰ্হিত কাজ থেকে বিরত রাখে।’ (ইবনে কাসির)

আয়াতে ব্যবহৃত “ফাহশা’ শব্দের অর্থ এমন সুস্পষ্ট মন্দ কাজ, যাকে প্রত্যেক বুদ্ধিমান ব্যক্তিই মন্দ মনে করে; যেমন ব্যভিচার, অন্যায়, হত্যা, চুরি, ডাকাতি ইত্যাদি। পক্ষান্তরে ‘মুনকার’ এমন কথা ও কাজকে বলা হয়, যার হারাম ও অবৈধ হওয়ার ব্যাপারে শরিয়ত বিশারদগণ একমত। (বাগভি, ফাতহুল কাদির)

ফাহশা’ ও ‘মুনকার’ শব্দদ্বয়ের মধ্যে যাবতীয় অপরাধ এবং প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য গুনাহ দাখিল হয়ে গেছে। যেগুলো স্বয়ং নিঃসন্দেহরূপে মন্দ এবং সৎকর্মের পথে সর্ববৃহৎ বাধা। নামাজের মাধ্যমে এ সব বাধা দূরীভূত হয়।

এখানে কেউ কেউ সন্দেহ করে যে, অনেক মানুষকে নামাজের অনুবর্তী হওয়া সত্বেও বড় বড় গুনাহে লিপ্ত থাকতে দেখা যায়। এটা আলোচ্য আয়াতের পরিপন্থী নয় কি?

এর কয়েকটি জওয়াব দেয়া হয়। এক. প্রকৃত নামাজ আদায়কারীকে নামাজ অবশ্যই অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখবে। হজরত হাসান ও কাতাদাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, যার নামাজ তাকে অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখল না সে নামাজ দ্বারা আল্লাহ থেকেই দূরে রয়ে গেল। (তাবারি)

দুই. ইবনে কাসির রাহিমাহুল্লাহ বলেন, এর অর্থ যারা নিয়মিত নামাজ আদায় করবে, তাদের এ অবস্থাটি তৈরি হবে। হাদিসে এসেছে, এক লোক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বলল, অমুক লোক রাতে নামাজ আদায় করে, আর সকাল হলে চুরি করে। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, অচিরেই তার নামাজ তাকে তা থেকে নিষেধ করবে।’ (মুসনাদে আহমাদ ২/৪৪৭)

আল্লাহর স্মরণ সর্বশ্রেষ্ঠ। এর কয়েকটি অর্থ হতে পারে।

এক. আল্লাহর জিকির সবচেয়ে বড় ইবাদাত। নামাজ বড় ইবাদাত হবার কারণ হচ্ছে, এতে আল্লাহর জিকির থাকে। সুতরাং যে নামাজে জিকির বেশি সে নামাজ বেশি উত্তম। (ইবনে কাসির)

দুই. আল্লাহর স্মরণ অনেক বড় জিনিস, সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ। মানুষের কোন কাজ এর চেয়ে বেশি বড় নয়। (তাবারি)

তিন. তোমার আল্লাহকে স্মরণ করার চেয়ে আল্লাহ কর্তৃক তোমাকে স্মরণ করা অনেক বেশি বড় জিনিস। (তাবারি)

মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা আমাকে স্মরণ করো আমি তোমাদের স্মরণ করবো।’ (সুরা আল-বাকারা: আয়াত ১৫২)

কাজেই বান্দা যখন নামাজে আল্লাহকে স্মরণ করবে। তখন অবশ্যই আল্লাহও তাকে স্মরণ করবেন। আর বান্দা আল্লাহকে স্মরণ করার তুলনায় আল্লাহর বান্দাকে স্মরণ করা অনেক বেশি মর্যাদার। বান্দা যখন আল্লাহকে স্মরণ করে, তখন আল্লাহ ওয়াদা অনুযায়ী স্মরণকারী বান্দাকে ফেরেশতাদের সমাবেশেও স্মরণ করেন। আল্লাহর এ স্মরণ ইবাদতকারী বান্দার সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত।

নামাজ পড়ার মধ্যে গুনাহ থেকে মুক্তির আসল কারণ হল আল্লাহ স্বয়ং নামাজ আদায়কারীর দিকে অভিনিবেশ করেন এবং ফেরেশতাদের সমাবেশে তাকে স্মরণ করেন।’ (বাগভি)

নবিজি সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শ্রেষ্ঠ মুজেজা

সুরা আনকাবুতে আল্লাহ তাআলা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শ্রেষ্ঠ মুজেজার বর্ণনা দিয়েছেন। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিরক্ষর হওয়া। অথচ তাঁর প্রতি নাজিল করেছেন সর্বকালের সর্বযুগের সেরা আসমানি গ্রন্থ কোরআনুল কারিম। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَ مَا کُنۡتَ تَتۡلُوۡا مِنۡ قَبۡلِهٖ مِنۡ کِتٰبٍ وَّ لَا تَخُطُّهٗ بِیَمِیۡنِکَ اِذًا لَّارۡتَابَ الۡمُبۡطِلُوۡنَ  بَلۡ هُوَ اٰیٰتٌۢ بَیِّنٰتٌ فِیۡ صُدُوۡرِ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡعِلۡمَ ؕ وَ مَا یَجۡحَدُ بِاٰیٰتِنَاۤ اِلَّا الظّٰلِمُوۡنَ

‘আপনি তো এর আগে কোনো কিতাব পাঠ করেননি এবং স্বীয় হাত দ্বারা কোনো কিতাব লেখেননি; তাহলে মিথ্যাবাদীরা অবশ্যই সন্দেহ পোষণ করত। বরং যাদেরকে জ্ঞান দেওয়া হয়েছে, তাদের অন্তরে ইহা (কোরআন) তো সুস্পষ্ট আয়াত। কেবল বে-ইনসাফরাই আমার আয়াতসমূহ অস্বীকার করে। ’ (সুরা আনকাবুত : আয়াত ৪৮-৪৯)

কোরআন নাজিল হওয়ার আগে আপনি কোনো কিতাব পাঠ করতেন না এবং কোন কিতাব লিখতেও পারতেন না; বরং আপনি ছিলেন নিরক্ষর। আল্লাহ তাআলা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়ত প্রমাণ করার জন্যে যেসব সুস্পষ্ট মুজেজা প্রকাশ করেছেন, তন্মধ্যে তাকে আগে থেকে নিরক্ষর রাখাও অন্যতম। এটি নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়তের সপক্ষে একটি প্রমাণ। তাঁর স্বদেশবাসী ও আত্মীয়-বান্ধবগণ, যাদের মধ্যে তিনি শৈশব থেকে প্রৌঢ়ত্ব পর্যন্ত জীবনকাল অতিবাহিত করেছিলেন, সবাই ভালোভাবে জানতো তিনি সারা জীবন কখনো কোনো বই পড়েননি এবং কলম হাতে ধরেননি।’ (ইবনে কাসির)

এ সত্য ঘটনাটি পেশ করে মহান আল্লাহ তাআলা বলছেন, এটি একথার সুস্পষ্ট প্রমাণ যে, আসমানি কিতাবসমূহের শিক্ষাবলী, আগের নবীগণের অবস্থা, বিভিন্ন ধর্ম ও দ্বীনের আকীদা-বিশ্বাস, প্রাচীন জাতিসমূহের ইতিহাস এবং সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মানবিক জীবন যাপনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলী সম্পর্কে যে গভীর ও ব্যাপক জ্ঞানের প্রকাশ ও নিরক্ষর নবির কণ্ঠ থেকে হচ্ছে তা তিনি অহি ছাড়া আর অন্য কোনো উপায়ে অর্জন করতে পারতেন না।’ (ফাতহুল কাদির)

যদি তিনি লেখাপড়া জানতেন তবে হয়ত কেউ বলতে পারত যে, তিনি আগেকার নবিদের কোনো কিতাব থেকে শিখে নিয়ে তা মানুষদের মধ্যে প্রচার করছেন। তবে মক্কার কিছু লোক রাসুলের নিরক্ষর হওয়া সত্বেও একথা বলতে ছাড়েনি যে, তিনি কারও কাছ থেকে লিখে নিয়ে তা সকাল-বিকাল পড়ে শোনাচ্ছেন। যেমন তারা বলেছিল-

وَ قَالُوۡۤا اَسَاطِیۡرُ الۡاَوَّلِیۡنَ اکۡتَتَبَهَا فَهِیَ تُمۡلٰی عَلَیۡهِ بُکۡرَۃً وَّ اَصِیۡلًا

‘তারা আরও বলে, এগুলো তো সেকালের উপকথা, যা সে লিখিয়ে নিয়েছে; তারপর এগুলো সকাল-সন্ধ্যা তার কাছে পাঠ করা হয়।’ (সুরা আল-ফুরকান: আয়াত ৫)

এ কথার জওয়াবে আল্লাহ তাআলা বলেন-

قُلۡ اَنۡزَلَهُ الَّذِیۡ یَعۡلَمُ السِّرَّ فِی السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ اِنَّهٗ کَانَ غَفُوۡرًا رَّحِیۡمًا

‘বলুন, এটা তিনিই নাজিল করেছেন যিনি আসমানসমূহ ও জমিনের সমুদয় রহস্য জানেন; নিশ্চয়ই তিনি পরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা আল-ফুরকান: আয়াত ৬)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনো লেখাই দেখে দেখে পড়তে পারতেন না। কোনো লেখা লিখতেও সক্ষম ছিলেন। আর এ নিরক্ষর অবস্থায়ই নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবনের প্রথম ৪০টি বছর পণ্ডিত মক্কাবাসীর সামনে অতিবাহিত করেন।

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো আসমানি কিতাবের অনুসারীদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখেননি। তাদের কাছ থেকে আসমানি কিতাবের কোনো বর্ণনাও শোনেননি। আর তৎকালিন সময়ে মক্কায় কোনো আসমানি কিতাবের অনুসারী পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গও ছিল না।

অথচ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৪০ বছরে উপনীত হওয়ার পর তাঁর মুখ থেকে এমন শব্দমালা উচ্চারিত হতে লাগলো, যা বিষয়বস্তু ও অর্থের দিক থেকে যেমন ছিল মুজেজাস্বরূপ এবং ভাষাগত শাব্দিক বিশুদ্ধতা ও ভাষার সৌন্দর্য ছিল অতুলনীয়।

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিরক্ষরতাই ছিল তৎকালীন সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ মুজেজা। যা মক্কার পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গের জন্য ছিল এক মহা চিন্তা ও শিক্ষার বিষয়। আর এটা ছিল তাওহিদ, রেসালাত ও আখেরাতের সত্যতার ওপর বিশ্বাস স্থাপনের এক মহা প্রমাণ। এ কোরআনই বিশ্ববাসীর জন্য রহমত। আল্লাহ তাআলা বলেন-

اَوَ لَمۡ یَکۡفِهِمۡ اَنَّاۤ اَنۡزَلۡنَا عَلَیۡکَ الۡکِتٰبَ یُتۡلٰی عَلَیۡهِمۡ ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَرَحۡمَۃً وَّ ذِکۡرٰی لِقَوۡمٍ یُّؤۡمِنُوۡنَ

‘এটাকি তাদের জন্য যথেষ্ট নয় যে, আমি আপনার প্রতি কিতাব নাজিল করেছি, যা তাদের কাছে পাঠ করা হয়। এতে অবশ্যই বিশ্বাসী লোকদের জন্য রয়েছে রহমত ও উপদেশ।’ (সুরা আনকাবুত : আয়াত ৫১)

তিনি নিরক্ষর হওয়া সত্বেও এই যে অপারগকারী কিতাব নিয়ে এসেছেন, যার মোকাবিলা কারও পক্ষে সম্ভব হয়নি, এটাই তো তাদের নিদর্শনের জন্য যথেষ্ট। এ কিতাবে রয়েছে পূর্ববর্তদের খবর, পরবর্তীদের খবর, তাদের মধ্যে ঘটে যাওয়া ব্যাপারসমূহের সঠিক ফয়সালা। তারপরও তারা কেন নিদর্শনের জন্য পীড়াপীড়ি করছে? (ইবনে কাসির)

তারা নিদর্শন দেখতে চায়। এই কোরআন যা আমি তোমার উপর অবতীর্ণ করেছি এবং যার ব্যাপারে তাদের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে এই বলে যে, এইরূপ কোরআন তৈরি করে অথবা একটি সুরা তৈরি করে উপস্থাপন কর, সেই কোরআন তাদের জন্য নিদর্শন হিসাবে যথেষ্ট নয় কি? যখন কোরআনের মুজেজা দেখার পরেও তারা কোরআনের প্রতি ঈমান আনছে না, তখন মুসা ও ঈসার মত মুজজা দেখানো হলেও তার উপর তারা কি ঈমান নিয়ে আসবে?

ঐ সকল মানুষের জন্য যারা কোরআনকে আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ কিতাব বলে বিশ্বাস করে। কারণ তারাই তা থেকে লাভবান ও উপকৃত হয়।

ঈমানদারদের প্রতি ইবাদত করার ঘোষণা ও সুনিশ্চিত মৃত্যুর ঘোষণা এসেছে। যেন তারা আল্লাহকে রব বলে স্বীকার করে। কেননা তাদের সবাইকে একদিন ফিরে যেতে হবে। আল্লাহ বলেন-

یٰعِبَادِیَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنَّ اَرۡضِیۡ وَاسِعَۃٌ فَاِیَّایَ فَاعۡبُدُوۡنِ  کُلُّ نَفۡسٍ ذَآئِقَۃُ الۡمَوۡتِ ۟ ثُمَّ اِلَیۡنَا تُرۡجَعُوۡنَ

‘হে আমার ঈমানদার বান্দাগণ, আমার পৃথিবী প্রশস্ত। অতএব তোমরা আমারই এবাদত কর। জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। অতঃপর তোমরা আমারই কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে।’ (সুরা আনকাবুত: আয়াত ৫৬-৫৭)

আলোচ্য আয়াতে মুসলিমগণের জন্যে কাফেরদের অনিষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করা, সত্য প্রচার করা এবং দুনিয়াতে ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করার একটি কৌশল বর্ণনা করা হয়েছে। এই কৌশলের নাম ‘হিজরত’ তথা দেশত্যাগ। অথাৎ যে দেশে সত্যের বিরুদ্ধে কথা বলতে ও কাজ করতে বাধ্য হতে হয়, সেই দেশ পরিত্যাগ করা। আল্লাহ বলেছেন, আমার পৃথিবী প্রশস্ত। কাজেই কারও এই ওজর গ্রহণ করা হবে না যে, অমুক শহরে অথবা দেশে কাফেররা প্রবল ছিল বিধায় আমরা তাওহিদ ও ইবাদাত পালনে অপারগ ছিলাম। তাদের উচিত, যে দেশে কুফর ও অবাধ্যতা করতে বাধ্য করা হয়, আল্লাহর জন্যে সেই দেশ ত্যাগ করা এবং এমন কোনো স্থান তালাশ করা, যেখানে স্বাধীন ও মুক্ত পরিবেশে আল্লাহর নির্দেশাবলী নিজেরাও পালন করতে পারে এবং অপরকেও উদ্বুদ্ধ করতে পারে। আর এজন্যই সাহাবায়ে কিরাম হাবশায় হিজরত করেছিলেন। এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও অন্য সাহাবিগণ মদিনায় হিজরত করেছিলেন।’ (ইবনে কাসির, ফাতহুল কাদির)

হিজরতের পথে প্রথম বাধা হলো, মৃত্যুর ভয়। স্বদেশ পরিত্যাগ করে অন্যত্র যাবার মধ্যে মানুষ প্রথম যে সমস্যাটির সম্মুখীন হয় তাহলো, নিজের প্রাণের আশংকা। স্বদেশ ত্যাগ করে অন্যত্র রওয়ানা হলে পথিমধ্যে স্থানীয় কাফেরদের সঙ্গেও প্রাণঘাতী সংঘর্ষের আশংকা বিদ্যমান থাকে। আয়াতে এই আশংকার জওয়াব দেওয়া হয়েছে যে, ‘জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। কেউ কোথাও কোনো অবস্থাতেই মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা পাবে না। কাজেই মৃত্যুর ভয়ে অস্থির হওয়া মুমিনের কাজ হতে পারে না। তাই স্বস্থানে থাকা অথবা হিজরত করে অন্যত্র চলে যাওয়ার মধ্যে মৃত্যুর ভয় অন্তরায় না হওয়া উচিত।’ (ফাতহুল কাদির)

বিশেষত আল্লাহর নির্দেশাবলী পালন করা অবস্থায় মৃত্যু আসা চিরস্থায়ী সুখ ও নেয়ামতের কারণ। আখেরাতে এই সুখ ও নেয়ামত পাওয়া যাবে। তাই প্ৰাণের কথা ভেবে ঈমান ও হিজরত থেকে পিছপা হয়ো না।

আল্লাহ তাআলা হিজরতের অন্তরায় আর যে বিষয়ে মানুষকে নির্ভয় দিয়েছেন, তাহলো-

الَّذِیۡنَ صَبَرُوۡا وَ عَلٰی رَبِّهِمۡ یَتَوَکَّلُوۡنَ   وَ کَاَیِّنۡ مِّنۡ دَآبَّۃٍ لَّا تَحۡمِلُ رِزۡقَهَا ٭ۖ اَللّٰهُ یَرۡزُقُهَا وَ اِیَّاکُمۡ وَ هُوَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ

‘যারা ধৈর্য ধারণ করে এবং তাদের রব-এর উপরই তাওয়াক্কুল করে। আর এমন কত জীব-জন্তু রয়েছে, যারা নিজদের রিজিক নিজেরা সঞ্চয় করে না, আল্লাহই তাদের রিজিক দেন এবং তোমাদেরও। আর তিনি সর্বশ্রোতা, মহাজ্ঞানী।’ (সুরা আনকাবুত: আয়াত ৫৯-৬০)

যারা সব রকমের সমস্যা, সংকট, বিপদ-আপদ, ক্ষতি ও কষ্টের মোকাবিলায় ঈমানের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। যারা ঈমান আনার বিপদ নিজের মাথায় তুলে নিয়েছে এবং মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। ঈমান ত্যাগ করার পার্থিব উপকারিতা ও মুনাফা যারা নিজের চোখে দেখেছে কিন্তু এরপরও তার প্রতি সামান্যতমও ঝুকে পড়েনি। যারা কাফের ও ফাসেকদের নিজেদের সামনে ফুলে ফেঁপে উঠতে দেখেছে এবং তাদের ধন-দৌলত ও ক্ষমতা-প্রতিপত্তির দিকে ভুলেও নজর দেয়নি। একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, তার কাছে যা আছে তা পাবার আশায়, তার ওয়াদার সত্যতায় বিশ্বাসী হয়ে আল্লাহর পথে হিজরত করেছে, শক্ৰদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছে। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে এসেছে, তাদের জন্যই স্থায়ী জান্নাত রয়েছে। (ইবনে কাসির)

যারা নিজেদের সহায়-সম্পত্তি, কাজ-করবার ও বংশ-পরিবারের ওপর ভরসা করেনি। বরং দ্বীন ও দুনিয়ার প্রতিটি কাজে নিজেদের রবের ওপর ভরসা করেছে। তারাই উক্ত জান্নাতের অধিকারী। (ইবনে কাসির)

যারা দুনিয়াবী উপায়-উপাদানের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে নিছক নিজেদের রবের ভরসায় ঈমানের খাতিরে প্রত্যেকটি বিপদ সহ্য করার জন্য তৈরি হয়ে যায় এবং সময় এলে বাড়িঘর ছেড়ে বের হয়ে পড়ে। যারা নিজেদের রবের প্রতি এতটুকু আস্থা রাখে যে, ঈমান ও নেকির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার প্রতিদান তাঁর কাছে কখনো নষ্ট হবে না এবং বিশ্বাস রাখে যে, তিনি নিজের মুমিন ও সৎকর্মশীল বান্দাদের এ দুনিয়ায় সহায়তা দান করবেন এবং আখেরাতেও তাদের কার্যক্রমের সর্বোত্তম প্রতিদান দেবেন।

হিজরতের পথে দ্বিতীয় আশংকা

হিজরতের পথে দ্বিতীয় আশংকা এই যে, অন্য দেশে যাওয়ার পর রুজি রোজগারের কি ব্যবস্থা হবে? জন্মস্থানে তো মানুষ কিছু পৈতৃক সম্পত্তি, কিছু নিজের উপার্জন দ্বারা বিষয়-সম্পত্তির ব্যবস্থা করে থাকে। হিজরতের সময় এগুলো সব এখানে থেকে যাবে। কাজেই পরবর্তী পর্যায়ে জীবননির্বাহ কীরূপে হবে? এ আয়াতসমূহে এর জওয়াব দেওয়া হয়েছে যে, অর্জিত আসবাবপত্রকে রিজিকের যথেষ্ট কারণ মনে করা ভুল। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তাআলাই রিজিক দান করেন। তিনি ইচ্ছা করলে বাহ্যিক আয়োজন ছাড়াও রিজিক দান করেন এবং ইচ্ছা না করলে সব আয়োজন সত্বেও মানুষ সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকতে পারে।

প্রমাণস্বরূপ প্রথম বলা হয়েছে- চিন্তা কর, পৃথিবীতে বিচরণকারী এমন হাজারো জীব-জন্তু আছে যারা খাদ্য সঞ্চয় করার কোনো ব্যবস্থা করে না। কিন্তু আল্লাহ তাআলা নিজ কৃপায় প্রত্যহ তাদেরকে খাদ্য সরবরাহ করেন। পৃথিবীর অসংখ্য ও অগণিত প্রকার জীব-জন্তুর মধ্যে অধিকাংশের অবস্থা এই যে, তারা খাদ্য সংগ্ৰহ করার পর আগামীকালের জন্যে তা সঞ্চিত রাখে না এবং এর প্রয়োজনীয় সাজ-সরঞ্জামও তাদের নেই।’ (ইবনে কাসির)

হাদিসে পাকে এসেছে, ‘পক্ষীকূল সকালে ক্ষুধার্ত অবস্থায় বাসা থেকে বের হয় এবং সন্ধ্যায় উদরপূর্তি করে ফিরে আসে।’ (তিরমিজি ২৩৪৪) অথচ তাদের না আছে ক্ষেত-খলা, না আছে জমি ও বিষয়-সম্পত্তি। তারা কোনো কারখানা অথবা অফিসের কর্মচারীও নয়। তারা আল্লাহ তাআলার উন্মুক্ত পৃথিবীতে বিচরণ করে এবং পেটভর্তি খাদ্যলাভ করে। এটা একদিনের ব্যাপার নয়। বরং তাদের আজীবন কর্মধারা।

সুরা রূম (৬০)

মক্কায় অবতীর্ণ ৬০ আয়াত বিশিষ্ট সুরায় বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়ত কেন্দ্রিক আলোচনা ওঠে এসেছে। যাতে নবুয়তের সত্যতার দলিল প্রমাণ উপস্থাপিত হয়েছে।

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোমানদের বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এবং এ সম্পর্কে কোরআনের আয়াতও নাজিল হয়েছিল। অবশেষে এ ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছে এ সুরায়। সুরাটিতে দুনিয়ার জীবনের ব্যাপ্তি নিতান্ত ক্ষণস্থায়ী উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন- ‘তিনি যাকে ইচ্ছা বিজয় দান করেন আবার সেই বিজয়ীকে পরাজিতও করেন।’ এতেই প্রমাণিত হয় যে, কারো বিজয় তার সত্যতার প্রমাণ নয়।

দুনিয়ার জীবনের সম্মান-মর্যাদা, অপমান সবাই আল্লাহর কর্তৃত্বাধীন। এরপরও অবিশ্বাসী সম্প্রদায় মুসলমানদের সাময়িক সময়ের দারিদ্র্যতার জন্য হেয় প্রতিপন্ন করে। যা সবিস্তার আলোচিত হয়েছে সুরা রূমে। এ সুরার আলোচ্য বিষয়গুলো হলো-

Loading

পোষ্টটি প্রয়োজনীয় মনে হলে শেয়ার করতে পারেন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!