জবির ভিসি-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল

জবির ভিসি-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রয়াত সহযোগী অধ্যাপক মীর মোশারেফ হোসেনকে (রাজীব মীর) বরখাস্তের আদেশ অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে চাকরিতে যেসব সুযোগ সুবিধাদি পেতেন, সে পরিমাণ অর্থ তার স্ত্রীকে দিতে কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে সেটি প্রতিপালন না করায় উপাচার্য ও রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।

উচ্চ আদালতের রায় কার্যকর না করায় আদালত অবমাননার অভিযোগে রাজীব মীরের স্ত্রী সুমনা খানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান ও বিচারপতি খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ৫ এপ্রিল এ আদেশ দেন। গত ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের দেওয়া আদেশের অনুলিপি প্রকাশ পায়। আদেশের অনুলিপি শনিবার (৬ মে) জাগো নিউজের হাতে আসে।

রুলে উচ্চ আদালতের আদেশ প্রতিপালন না করায় (কার্যকর না করায়) তাদের বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়েছে। চার সপ্তাহের মধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. ইমদাদুল হক ও রেজিস্ট্রার মো. ওহিদুজ্জামানকে এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

আদালতে ওইদিন রিটের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন অ্যাডভোকেট ড. শাহীদ মালিক। অন্যদিকে, রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার। তার সঙ্গে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল বাহাউদ্দিন আহমেদ, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ রেজাউল হক, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সেলিম আজাদ ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সিরাজুল ইসলাম।

তার আইনজীবীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অসদাচরণ, নৈতিক স্খলন, কর্তব্যে অবহেলাসহ অপেশাদারি নানা অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১৭ সালের ১০ আগস্ট রাজীব মীরকে বরখাস্ত করেন। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পরে এ তদন্ত কমিটি যে প্রতিবেদন দেয় তার কোনো অনুলিপি রিটকারীকে সরবরাহ না করে অর্থাৎ রিটকারীকে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সাক্ষ্য-প্রমাণ সম্পর্কে না জানিয়েই তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অর্থাৎ আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ না দিয়েই তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে, যা বেআইনি ও অবৈধ।

বরখাস্তের আদেশটি চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট আবেদন করেন সহযোগী অধ্যাপক মীর মোশারেফ হোসেন(রাজীব মীর)। সেটির শুনানি নিয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।

২০১৮ সালের ৩০ জানুয়ারি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মীর মোশারেফ হোসেনকে (রাজীব মীর) বরখাস্তের আদেশ কেন বেআইনি ও অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি তার জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী বকেয়া সব বেতন-সুবিধাসহ তাকে কেন স্বপদে পুনর্বহাল করা হবে না জানতে চাওয়া হয় রুলে।

চার সপ্তাহের মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়র উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। ওই শিক্ষকের করা রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন।

রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী শাহদীন মালিক। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী এম মঞ্জুর আলম ও মো. তায়্যিব-উল-ইসলাম সৌরভ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আলামিন সরকার। ওই রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০২২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট।

রায়ে শিক্ষক মীর মোশারেফ হোসেনকে (রাজীব মীর) চাকরি থেকে বরখাস্তের আদেশ অবৈধ ঘোষণা করা হয়। সেই সঙ্গে তিনি জীবিত থাকলে আইন অনুযায়ী চাকরিতে যে আর্থিক সুবিধাদি পেতেন, তা তার স্ত্রীকে দিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত। বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য ও রেজিস্ট্রারের প্রতি আদেশ প্রতিপালন না করায় আদালত অবমাননার এই রুল জারির নির্দেশ এলো।

নিজ বিভাগের শিক্ষার্থীর আনা যৌন হয়রানির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। ২০১৭ সালের ১০ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এ সংক্রান্ত আদেশের বৈধতা নিয়ে হাইকোর্টে রিট করেন তিনি।

রিট আবেদনের তথ্য অনুযায়ী, রাজীব মীরকে যে অভিযোগে বরখাস্ত করা হয়, সেই অভিযোগ তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দিয়েছিল। তবে রাজীব মীরকে এর কপি না দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দ্বিতীয় কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পেতে আবেদন করেও বিফল হন তিনি। তদন্ত প্রতিবেদন না দিয়েই শাস্তিমূলক ওই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যে কারণে রাজীব মীর যথাযথভাবে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাননি, যা ন্যায়বিচারের পরিপন্থি।

রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০১৮ সালের ৩০ জানুয়ারি হাইকোর্ট রুল জারি করে আদেশ দেন। এরই মধ্যে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দেশের বাইরে একই বছরের ২১ জুলাই মারা যান রাজীব মীর। এ অবস্থায় রিটে আবেদনকারী হিসেবে তার স্ত্রী সুমনা খান ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর স্থলাভিষিক্ত হন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট রায় ঘোষণা দেন।

এ রায় স্থগিত চেয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করে। যা গত ৫ এপ্রিল আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালতে শুনানির জন্য তোলা হয়। সেদিন চেম্বার জজ আদালত আবেদনটি আগামী ৫ জুন আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠান। অন্যদিকে হাইকোর্টের রায় কার্যকর না হওয়ায় আদালত অবমাননার অভিযোগে তুলে আবেদন করেন সুমনা খান। শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট আদালত অবমাননার রুল জারি করে আদেশ দেন। ওই আদেশটি ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের বিচারকদের সইয়ের পর সেই অনুলিপি প্রকাশ করা হয়েছে।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার বলেন, ‘হাইকোর্ট রাজীব মীরের বরখাস্তের আদেশ বেআইনি ঘোষণা করেছেন। জীবিত থাকলে তার চাকরিতে পুনর্বহালের আদেশ হতো। যেহেতু তিনি মারা গেছেন, তাই মারা যাওয়ার দিন পর্যন্ত তিনি চাকরিতে ছিলেন বলে ধরে নিতে হবে। এ হিসাবে আইন অনুসারে তার চাকরির আর্থিক সুবিধাদি তার স্ত্রীকে দিতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।’ তিনি আরও বলেন, ‘এক বছরের বেশি সময় গেলেও এই রায় বাস্তবায়ন হয়নি। রায় বাস্তবায়ন না করায় হাইকোর্ট ইতিমধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও রেজিস্ট্রারের প্রতি আদালত অবমাননার রুল জারি করেন। এখনো রুলের জবাব আসেনি।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন রাজীব মীর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন রাজীব মীর। কবিতা লেখা ছাড়াও নিয়মিত লেখালেখি করতেন তিনি। সমাজকর্মী ও গবেষক হিসেবেও সুনাম অর্জন করেছিলেন।

Loading

পোষ্টটি প্রয়োজনীয় মনে হলে শেয়ার করতে পারেন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!