পণ্য হিসেবে নয় আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে চাই

পণ্য হিসেবে নয় আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে চাই

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

নীলিমা আফরোজ। সরকারের উপ-সচিব। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সমন্বয় ও প্রশিক্ষণ অধিশাখার দায়িত্বে রয়েছেন। পাশাপাশি প্রশাসন অধিশাখার অতিরিক্ত দায়িত্ব তার।

কুমিল্লার বরুড়া থেকে স্কুল কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোকপ্রশাসনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। ইংল্যান্ডের গ্রিন উইচ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্টেও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন।

পেশাগত জীবনে পূবালী ব্যাংকের অফিসার হিসেবে কাজ শুরু করলেও বিসিএসের মাধ্যমে যোগ দেন প্রশাসনে। ২৭ ব্যাচের এই কর্মকর্তা সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, টাঙ্গাইল, সহকারী কমিশনার (ভূমি) টাঙ্গাইল সদর এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, কচুয়া, চাঁদপুর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে সরকারের মধ্যম সারির এই আমলার সঙ্গে কথা হয়েছে জাগো নিউজের। অকপটে নারীর অতিমাত্রায় স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছেন। বলেছেন, নারীবাদীরা আসলে নারীর জন্য ইতিবাচক না। অতি নারীবাদী হওয়ার চেয়ে আত্মসম্মান রক্ষা করে চলা উচিত।

নারীদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষা, আর্থিক সক্ষমতা ও স্বনির্ভরতা জরুরি বলে মনে করেন তিনি। তার দাবি, অনেক স্মার্ট মেয়ে দেখেছি, কিন্তু আত্মসম্মান নেই।

নীলিমা আফরোজ: আমি মূলত লোক প্রশাসনের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ে জেন্ডার নিয়ে একটা কোর্স ছিল আমাদের। সেখানে ফেমিনিজম একটা টার্ম ছিল। সেটি পড়তে গিয়ে আমরা দেখেছি- নারীবাদী যারা, তারা আসলে নারীর জন্য ইতিবাচক না। অতিমাত্রায় নারীবাদীত্বের কারণে আমরা আমাদের সাবলীলতা নষ্ট করে ফেলি। এটা হলো বাস্তবতা। বাংলাদেশে এখন নারীরা কিন্তু বিশেষ সুবিধা বা অধিকারপ্রাপ্ত। কারণ, সংসদে নারী আসন সংরক্ষিত। চাকরিতে একটা বড় সময় পর্যন্ত সব যায়গায় ১০ শতাংশ কোটা আমরা নিয়েছি। আর এখন তো কোটা দরকার নেই। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি, ফলাফলসহ সব যায়গায় নারীরা এগিয়ে থাকে। বিশেষ সুবিধা বা অধিকার পেয়েই কিন্তু তুলনামূলক এই ভালো পর্যায়ে এসেছে। অথচ আমেরিকায় নারীদের শুধু ভোটাধিকার পেতে ৬০ বছরের বেশি সময় লেগেছে। সেখানে আমাদের তো স্বাধীনতার পর কখনো এমনটা হয়নি যে, আমরা ভোট দিতে পারবো না বা নারী নেতৃত্বে আসতে পারবে না। আমি সক্ষম নারী হলে অবশ্যই নেতৃত্বে আসতে পারছি। আমার তৃণমূলে অনেক নারী নেতৃত্ব আছে- মেম্বার বা চেয়ারম্যান; যোগ্য যে সে কিন্তু ফাইট করে এগিয়ে যাচ্ছে। যে যোগ্য না অথচ নেতৃত্বে আসতেছে, তাকে তো আপনি এগিয়ে নিতে পারবেন না।

আমরা যে লেভেলে আছি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সুবিধা পাই, কারণ আমরা রাষ্ট্রের সুবিধাজনক অবস্থানে। কিন্তু আমার আড়াই বছরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) থাকাকালীন আমি দেখেছি যে, নারী দিবসের যৌক্তিকতা কী? বা সমাজে নারীদের অবস্থান কী? কারণ আমি নিয়মিত গণশুনানি নিতাম।

‘ওখানে ৮০ শতাংশ নারীরাই আসত। বেশিরভাগ পরিবারে ভিকটিম। হয়ত সে বাল্যবিয়ের শিকার অথবা স্বামী কর্তৃক নির্যাতিত বা শ্বশুড় বাড়ির লোকজন দ্বারা নির্যাতিত। এই বিচার করতে গিয়ে মোটামুটি আমার আড়াই বছর পার হয়েছে। তার মানে ওই যায়গাটায় আমাদের উন্নতি কিন্তু খুব বেশি হয়নি। আরও ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে- গ্রামীণ ওই নির্যাতিত নারীদের আদালত পর্যন্ত যাওয়ার সক্ষমতাও নাই। যদিও আমাদের দেশে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে শক্ত আইন আছে, পৃথক আদালত আছে। আমার কাছে (ইউএনও) আসাও তাদের পক্ষে সহজ ছিল না। অনেকে লুকিয়ে আসছে। এই হলো সমাজের বাস্তবতা।

>নীলিমা আফরোজ: কর্মজীবনের শুরুটা ছিল চ্যালেঞ্জের, কষ্টের। ২০০৬ সালে আমি ব্যাংক দিয়ে জব শুরু করি। ২০০৭ সালে আমার সন্তান হয়। তখন ছিল চার মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি। ওই সময়ে ব্যাংকের রুলস ছিল- চাকরি স্থায়ী না হলে মাতৃত্বকালীন ছুটি পাওয়া যাবে না। এটা কিন্তু কোনোভাবেই ঠিক নয়। আমি নারী, আমার বাচ্চা হবে, আমাদের ছুটি দিতে হবে— এটা আমার অধিকার। ওই সময়টা আমার জন্য বেশ কঠিন ছিল। আর চার মাসে একটা বাচ্চার দুগ্ধপানের জন্য যথেষ্ট সময় নয়। অন্তত ছয় মাস লাগে। বিদেশে এটা এক বছর। প্রতিবেশী ভারতেও দুই বছর। একবছর পূর্ণ বেতনে, অর্ধ বেতনে যদি হয়, তাহলে আরও এক বছর। দুই বছরে কিন্তু একটা বাচ্চা শেপে চলে আসে।

‘চার মাসের বাচ্চা রেখে মার্তৃকালীন ছুটি শেষে অফিসে জয়েন করলাম। দুপুরে আধা ঘণ্টা সময় পেতাম। আমার ব্যাংক থেকে বাসা ছিল হাটার পথ। কিন্তু ৩০ মিনিটে খাবো না কি বাচ্চাকে খাওয়াবো? সকাল ৮ থেকে বিকেল ৫/৬টা পর্যন্ত সময়, কিন্তু একজন মায়ের জন্য খুবই কঠিন ছিল। মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ম অনুযায়ী আমি পাই না, কিন্তু ওই সময়ের ম্যানেজার আমাকে সহযোগিতা করেছেন। আমার ছুটিটা চাকরি স্থায়ী হওয়ার পর দেখিয়ে দিয়েছেন। এটা কিন্তু ইতিবাচক। কিন্তু ওই যে একটা সুযোগ দেওয়া, যেটা পুরুষ সহকর্মীরা চাইলে দিতে পারত। এটা আমি ভুক্তভোগী দেখে হয়তো আমি ভাবি- আমার সঙ্গে কেউ থাকলে সে সুযোগ তাকে দেওয়া উচিত।

‘তারপর তো ব্যাংক শেষ। প্রশাসনে জয়েন করলাম। প্রথমে কিন্তু পরিবার থেকেই নিজের মত করে মুভ করা, একা একা ঢাকা থেকে দৌড়ানো, এটা কিন্তু অনেকে নিতে পারে নাই। কিন্তু একটা পর্যায়ে যখন চাকরি শুরু হয়ে গেল- ম্যাজিস্ট্রেট মোবাইল কোর্টে যাচ্ছে, ম্যাজিস্ট্রেট দৌড়াচ্ছে। তখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। অফিসেও প্রথম দিকে চ্যালেঞ্জিং কাজ দিত না। নারী হিসেবে স্যাররা দেননি। হয়ত ইতিবাচকভাবে দেখেছেন তারা। কিন্তু একটা পর্যায়ে দেখা গেছে, যত কঠিন মোবাইল কোর্ট ছিল, সেগুলো আমার ঘাড়ে পড়ত। লাশ উত্তোলন একটা ডিউটি ছিল আমাদের। ওই সময়ে ডিসি স্যার বললেন, আপনি যাবেন? আমি বললাম- স্যার কেন নয়? আমি তো অফিসার। আমার তো নারী-পুরুষ বিষয় না। যদি সমস্যা হয়, নারীরও হতে পারে, পুরুষেরও। পরে গেলাম।

‘ওই সময়ে কর্মক্ষেত্রে দেখেছিলাম- আমাদের সকাল ৯টায় অফিসে আসার বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু বাসায় ফেরার সময় নির্ধারিত ছিল না। শুক্র-শনিবার ছিল না। তখন আমার বাচ্চার বয়স ২/৩ বছর ছিল। যদিও তখন আমার মা ও শাশুড়ি বেশ সাপোর্ট দিয়েছে। কিন্তু একটা মানসিক চাপ ছিল তখন। বাচ্চাটাকে যদি অফিসের পরিবেশে রাখতে পারতাম, যেটা বিদেশে আছে। তাহলে কিন্তু আমাদের কাজের গতি অনেক বাড়ত। আমি আমার চাকরির ক্ষেত্রে খুব বেশি বৈষম্যের শিকার হয়েছি বলে আমার কাছে মনে হয়নি। আমার প্রত্যাশা কম দেখে হয়ত সেটা হতে পারে।

নীলিমা আফরোজ: ইউএনও হিসেবে যখন জয়েন করতে গেলাম কচুয়ায়। তখন এক সিনিয়র স্যার তো বলেই ফেললেন, তোমাকে দিলো? অর্থাৎ পুরুষ একজন শক্ত কাউকে দিলে হয়ত ভালো হত। আমাকে কেন দিলো? ওইটা একটা ধাক্কা খেলাম। পরে আসলাম কচুয়ায়। সেখানে প্রথম নারী ইউএনও আমি। লোকজনের নারী হিসেবে গ্রহণ করা কঠিন ছিল। উপজেলা মসজিদের সভাপতি ছিলাম আমি। আমার সাক্ষরে ইমাম সাহেবের বেতন হতো।

‘‘২০১৭ সালে ১৬ ডিসম্বেরের অনুষ্ঠান আসছে। স্বভাবত স্থানীয়ভাবে ফান্ড সংগ্রহের জন্য বলা হয়। আমার স্ট্যাটেজি ছিল ভিন্ন। ড্রেজারের বালু উত্তোলন করে যারা, বড় টাকা আসে ওখান থেকে। আমি তাদের অফিসের আশপাশেও ভিড়তে দেই না। কারণ আমি তো তাদের টাকা নিবো না। ওই সময় একটা সংকট ভাব। কিন্তু ওইটাই ছিল কচুয়ার সবচেয়ে বড় প্রোগ্রাম। ওই সময়ে উপজেলা পর্যায়ে কোনো এক বড় নেতা বলেছিলেন, ‘মহিলা ইউএনও আসছে, এবার মনে হয় অনুষ্ঠানের ব্যানারও টানানো হবে না।’ ওই সময় উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এসে বলেছেন বিষয়টি। আমি বললাম, কাজ হোক, দেখবেন তো। পরে আমি অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগেই তাদের উপস্থিতিতে আমি বলেছিলাম, যারা বলেছে- তারা দেখুক কচুয়ায় এ যাবত কালে এর চেয়ে বড় অনুষ্ঠান হয়েছে কি না। এ ধরনের কিছু মানসিকতা তো ছিল কর্মজীবনে। তবে আমি আমার অফিসারদের কাছে এমন কিছু পাইনি।

নীলিমা আফরোজ: হ্যাঁ, একটা বিষয় সব যায়গায় দেখা যায়, আমরা যারা চাকরি করি। আমাদের পুরুষ অফিসার ভাবে- আমি যেহেতু নারী, চাকরি করি। আমার স্বামীও ইনকাম করে। আমি অনেক বড় লোক। এটা একটা কমন মানসিকতা। যার স্ত্রী চাকরি করে না। সবাই দয়া তাকে দেখায়। মনে করে, অর্থনৈতিক ব্যাপারটা তার দরকার। কাজ করতে গেলে আমার সুবিধার সময়- আমার বাচ্চা বা পরিবারের সমস্যা, তখন ছাড় দিচ্ছেন না। কিন্তু অর্থনৈতিক ব্যাপারে ভাবছেন, তার দরকার নেই। এটা কেন হবে? আমি চাকরি করি আমার ফ্যামিলি সেক্রিফাইস করে। তাহলে ফিন্যান্সিয়াল ডিলিংস তো আমারও দরকার আছে। আর্থিক সুবিধা আমার দরকার আছে না? এরকম কিছু ছোটখাটো বিষয় আছে।

‘আরেকটা বিষয় হলো- নারীদের উচিত পরিবারের সঙ্গে থাকা। কিন্তু এটা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যায়। চাকরির ক্ষেত্রে সবাই ঢাকায় থাকতে চায়। যদিও এটি সম্ভব না। তবে পারিবারের কাছাকাছি দেওয়া প্রয়োজন। যদিও পদায়নে আমার তেমন সমস্যা হয় না।’

নীলিমা আফরোজ: সর্বপ্রথমে বলবো, শিক্ষা। সব পর্যায়ে নারীর শিক্ষাটা জরুরি। আর আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি- নারীর আর্থিক ক্ষমতায়ন খুব জরুরি। কেউ যদি বাসায় বসে ফুচকা বানিয়ে টাকা ইনকাম করে, করুক। মেয়েদের সোর্স অব ইনকাম থাকা উচিত। মেয়েদের শ্বশুর বাড়ি বা বাবার বাড়ি বলেন, সবখানে আপনি কত গুণী বউ বা আপনি কত বড়লোক বাবার মেয়ে, এটার চেয়ে বড় কথা আপনি মাসে ইনকাম করেন কি না। আর্থিক সক্ষমতা, আর্থিক স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতা মেয়েদের সবার আগে জরুরি। কারণ, আমার ক্ষেত্রে আমি বলবো- আমি যখন ভয়েস রেইজ করি, আমার শ্বশুর বাড়ি আমাকে প্রাধান্য দিচ্ছে, অবশ্যই সার্ভিসের কারণে। আমার ননদ আছে প্রাইমারির শিক্ষক, সেও প্রিভিলেজ পাচ্ছে তার চাকরির কারণে। অথচ আমার ননাসের মেয়ে আছে, অনার্স পড়ছে, ভালো যায়গায় বিয়ে হয়েছে, কিন্তু চাকরি নাই। বাবার বাড়ি থেকে যা যাচ্ছে তাও খাওয়ার সুযোগ থাকে না। এজন্য মেয়েদের অর্থ উপার্জনের যায়গায় যাওয়া উচিত।

‘পাশাপাশি প্রত্যেকের অতি নারীবাদী হওয়ার চেয়ে আত্মসম্মান রক্ষা করে চলা উচিত। আমরা নারীরা বিভিন্ন যায়গায় পণ্য হিসেবে ব্যবহার হই। আমি নিজেও এতে খুশি হই। এটার চেয়ে প্রয়োজন আমাকে কতটা মর্যাদা দিচ্ছে। যেখানে মেয়ে দরকারই নেই, সেখানেও সাজিয়ে গুছিয়ে একটা মেয়ে নিচ্ছে। তার অর্থ কী, তাকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আমি যে লেভেলে যাই, এমন ট্রিটমেন্ট পেতে চাই না। সরি টু সে, আমরা উপরের পর্যায়ে আছি, এখানেও এমনটা হয়। এই জিনিসটা আমার পছন্দ নয়। আমি এখানে অফিসার। আমি মানুষ। আমাদের নারীদের এই আত্মসম্মানবোধ জরুরি। অনেক স্মার্ট মেয়ে দেখেছি, কিন্তু এই আত্মসম্মান নেই।

Loading

পোষ্টটি প্রয়োজনীয় মনে হলে শেয়ার করতে পারেন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!