পদোন্নতি বঞ্চনা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা হতাশ

পদোন্নতি বঞ্চনা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা হতাশ

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

দেশের সরকারি হাসপাতালে গাইনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা পদোন্নতি বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। নিয়োগ ও পদোন্নতি নিয়মিত না হওয়ায় তাদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। প্রজনন স্বাস্থ্যসেবায়ও বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ৬৩৮টি সরকারি হাসপাতালের গাইনি বিভাগে ১ হাজার ৫২৬ জন গাইনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। তাদের মধ্যে ৯৯৩ জন সহকারী অধ্যাপক ও ২৮৯ জন সহযোগী অধ্যাপক পদোন্নতির অপেক্ষায়। অথচ গাইনি বিভাগে সহকারী, সহযোগী ও অধ্যাপকের সৃষ্ট পদের সংখ্যা মাত্র ২১৪টি। আবার ৪৮টি অধ্যাপক পদের বিপরীতে ২৯টি এবং ৬৬টি সহযোগী অধ্যাপক পদের বিপরীতে ৩৬টি পদ শূন্য রয়েছে। তবে সহকারী অধ্যাপকের ১০০টি পদের বিপরীতে ২২০ জন কাজ করছেন। এর বাইরে কিছু সংখ্যক জুনিয়র কনসালট্যান্ট ও মেডিকেল অফিসার রয়েছেন।

প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের সংগঠন অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি) সূত্রে জানা যায়, ২০তম বিসিএস উত্তীর্ণ মেডিসিন ও সার্জারি বিষয়ের চিকিৎসকরা অধ্যাপক হিসাবে কাজ করছেন। অন্যদিকে গাইনি বিভাগে ১৭তম বিসিএস পর্যন্ত চিকিৎসকরা অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। মেডিসিন ও সার্জারিতে ২৪তম পর্যন্ত সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।

অপরদিকে গাইনিতে ২০তম পর্যন্ত পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। একইভাবে মেডিসিন ও সার্জারিতে ২৫তম পর্যন্ত সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেলেও গাইনিতে ২১তম পর্যন্ত সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এমনকি ২১তম বিসিএসে উত্তীর্ণ গাইনি চিকিৎসকদের বড় একটি অংশ বঞ্চিত হয়েছেন। তারা পদোন্নতির অপেক্ষায় রয়েছেন। এছাড়া অন্যসব বিষয়ে ৩৩তম বিসিএস পর্যন্ত জুনিয়র কনসালট্যান্ট হলেও গাইনিতে ২৭তম এবং অল্প সংখ্যক ২৮তম বিসিএস পর্যন্ত পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। চলতি বছর ২৫৪ জন জুনিয়র কনসালট্যান্ট গাইনিতে বিশেষজ্ঞ ডিগ্রি অর্জন করে পদোন্নতির অপেক্ষায় রয়েছেন।

সূত্র আরও জানায়, পদোন্নতির যোগ্য চিকিৎসকদের অনেকেই উচ্চতর স্কেল (৬ষ্ঠ গ্রেড ও তদূর্ধ্ব গ্রেড) অর্জন করেছেন। পদোন্নতি প্রার্থীর সংখ্যা এত বেশি যে শুধু পদ সৃষ্টির প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে জনগণের চাহিদাকে বিবেচনায় নিয়ে অবশ অ্যান্ড গাইনি ও গাইনি সাব-স্পেশালিটি বিষয়ে পর্যাপ্ত সংখ্যক নতুন পদ সৃষ্টির প্রয়োজন।

২২তম বিসিএসে উত্তীর্ণ (স্বাস্থ্য ক্যাডার) নরসিংদী সদর হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. অসীম কুমার সাহা যুগান্তরকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী বিভাগীয় পরীক্ষায় পাশ এবং ফাউন্ডেশন ট্রেনিং সম্পন্ন হলে চাকরি স্থায়ী হয়। স্থায়ী ও চাকরির বয়স চার বছর হলে সিনিয়র স্কেলে পরীক্ষা দেওয়া যায়। উত্তীর্ণরা পদোন্নতির যোগ্য হন। প্রতি বছর ১৭০ থেকে ২০০ এফসিপিএস এবং ১০ জনের মতো এমএস ডিগ্রিধারী গাইনি চিকিৎসক বের হলেও পদোন্নতি পাচ্ছেন না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গাইনিতে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য ২৩২ জনের প্রস্তাবনা ছিল। কিন্তু অদৃশ্য কারণে সেটিও কাটছাঁট করে মাত্র ৯৫ জনের পদোন্নতির প্রক্রিয়া চলছে। অথচ সহকারী অধ্যাপকের জন্য ৯৯৩ জন চিকিৎসক পদপ্রার্থী রয়েছে। ৮০ জন সাব-স্পেশালিটি চিকিৎসক ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভরোগ, বন্ধ্যত্ব ও গাইনি ক্যানসার বিষয়ে ডাবল এফসিপিএস পাশ করে বসে আছেন। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রতিদিন হাসপাতালে আসা রোগীদের প্রায় ৪০ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসেন। কিন্তু পর্যাপ্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে সেবা ব্যাহত হচ্ছে।

ইমিরেটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, দেশে গাইনি রোগ চিকিৎসায় বিশাল সংখ্যক দক্ষ জনবল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে শুরু করে মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত কর্মরত আছেন। যোগ্যতার মূল্যায়নের মাধ্যমে কাজের সঠিক প্রয়োগ হয়। তা না হলে বিশেষজ্ঞদের মেধার অপচয় হয়। অভিজ্ঞ গাইনিকোলজিস্টদের পদোন্নতির মাধ্যমে তাদের ন্যায্য পদে পদায়ন করলে সব অঞ্চলের জনগণ উন্নত চিকিৎসা নিতে পারবে। কিন্তু গাইনি চিকিৎসকদের নতুন পদ সৃষ্টি ও পদোন্নতিতে দীর্ঘ জট তৈরি হয়েছে। এটা এক ধরনের বৈষম্য। গাইনি বিভাগে সহকারী, সহযোগী ও অধ্যাপকের নতুন পদ সৃষ্টি করে দ্রুত পদোন্নতি দেওয়া উচিত। না হলে জটিলতা দূর হবে না। প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হবে।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ডা. রাশেদা সুলতানা যুগান্তরকে বলেন, পদোন্নতি বঞ্চিতের কোনো তথ্য তার জানা নেই। পদোন্নতি পদায়ন মন্ত্রণালয়ের কাজ। অধিদপ্তর থেকে শুধু চাহিদামাফিক তথ্য পাঠানো হয়। এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ বলতে পারবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (হাসপাতাল অনুবিভাগ) নাজমুল হক খান বলেন, পদোন্নতির বিষয়টা প্রশাসন অনুবিভাগ দেখে। তারা বিস্তারিত বলতে পারবেন। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার ও অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন অনু বিভাগ) মো. সাইদুর রহমানের সঙ্গে একাধিকবার যোগা?যোগ করা হলেও তারা সাড়া দেননি।

স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা জানান, ফিটোম্যাটারনাল মেডিসিন (হাইরিস্ক প্রেগনেন্সি), গাইনোকোলজিক্যাল অনকোলজি (ক্যানসার), রিপ্রোডাক্টিভ এন্ডোক্রাইনোলজি অ্যান্ড ইনফার্টিলিটি (বন্ধ্যত্ব) বিষয়ে প্রতি বছর এফসিপিএস, এমএস ডিগ্রিধারী দক্ষ চিকিৎসক বের হচ্ছেন। সরকারের এমডিজি অর্জন ও এসডিজি অর্জনে তারা মাতৃ মৃত্যুহার, শিশু-মৃত্যুহার, ক্যানসার, বন্ধ্যত্বের চিকিৎসা দিচ্ছেন। সরকারি চাকরির নিয়ম অনুযায়ী-পাঁচ বছর একই পদে থাকার পর স্বয়ংক্রিভাবে পদোন্নতি হবে। কিন্তু অবশ অ্যান্ড গাইনি ও গাইনি সাব স্পেশালিটিতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ কম। বিভিন্ন উপজেলায় অনেকে ১০ থেকে ১৩ বছর ধরে জুনিয়র কনসালট্যান্ট হিসাবে কর্মরত রয়েছেন। প্রাপ্য পদোন্নতি থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন।

হেলথ বুলেটিনের সর্বশেষ তথ্যমতে, ২০২০ সালে সন্তান প্রসবকালে প্রতি লাখে মাতৃমৃত্যু ছিল ১৬৩ জন। কিন্তু জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা ছিল এই মৃত্যু প্রতিলাখে ১২১ জনে নামিয়ে আনা। এ ছাড়া ২০২৫ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যু কমিয়ে প্রতি লাখে ৮৫ জনে নামিয়ে আনতে হবে। ২০৩০ সালের টেকসই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে ৭০ জনে নামিয়ে আনতে হবে। দক্ষ গাইনি চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে সন্তান প্রসব ৮০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। তাই সরকারের উচিত প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে জড়িত জেনারেল অবশ অ্যান্ড গাইনি ও গাইনি সাব-স্পেশালিটি বিভাগে অধিক সংখ্যায় (সুপার নিউমেরারি পদ) পদায়ন করা। না হলে জট খুলবে না। প্রয়োজনীয় পদ না থাকায় বঞ্চিত চিকিৎসকের সংখ্যা আরও বাড়বে।

Loading

পোষ্টটি প্রয়োজনীয় মনে হলে শেয়ার করতে পারেন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!