নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠছে বাংলাদেশ। উত্তরণের এই পর্ব যেন মসৃণ হয়, সেজন্য বিশ্বব্যাংকের সহায়তা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এছাড়া উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হিসাবে উত্তরণ লাভে ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ বাস্তবায়নে সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য সংস্থাটির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। সোমবার ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক সদর দপ্তরের প্রিস্টন অডিটোরিয়ামে বিশ্বব্যাংক-বাংলাদেশ অংশীদারত্বের ৫০ বছরের প্রতিফলন শীর্ষক অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে তিনি এই সহযোগিতা চান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য বাস্তবায়নে বাংলাদেশ অবকাঠামো ও লজিস্টিকসে বিনিয়োগ অব্যাহত রাখবে। আশা করব, বিশ্বব্যাংক আগামী বছরগুলোয় আমাদের ভৌত ও সামাজিক উভয় খাত বিশেষ করে মেগা প্রকল্পগুলোয় সম্পৃক্ত হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার জাতীয় আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে জাতিসংঘের এসডিজির সমন্বয় করেছে। এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের বর্ধিত, ছাড় দেওয়া এবং উদ্ভাবনী অর্থায়নের জরুরি প্রত্যাশা রয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, মহামারি, সশস্ত্র সংঘাত এবং জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি সংকট বেশির ভাগ উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে গুরুতর চাপের মধ্যে ফেলেছে। মহামারি ও সশস্ত্র সংঘাত থেকে উদ্ভূত একাধিক সংকট সত্ত্বেও কিছু উন্নয়ন অংশীদার তাদের ঋণের খরচ এবং সুদের হার বাড়িয়েছে। আমি বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য উন্নয়ন অংশীদারকে কার্যকর বিকল্প খুঁজে বের করার আহ্বান জানাচ্ছি যাতে আমাদের অর্থনীতি উদ্ভূত চ্যালেঞ্জগুলো আরও ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ আশা করে, জলবায়ুসংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে বিশ্বব্যাংকের বর্ধিত সম্পৃক্ততা প্যারিস চুক্তির অধীনে অর্থায়নের ঘাটতি পূরণে সহায়তা করবে। আমরা জলবায়ু প্রশমন ও অভিযোজনের মধ্যে অর্থায়নের সমান বণ্টনের ওপর জোর দেব।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও প্রস্তুতিতে বিশ্বে রোল মডেল হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে এবং আগাম সতর্কতাব্যবস্থা, দুর্যোগসহিষ্ণু অবকাঠামো এবং সম্প্রদায়ভিত্তিক পদক্ষেপের ক্ষেত্রে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে আমরা জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি।
কিন্তু আজ পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাও ফিরে যায়নি। তিনি বলেন, পরিস্থিতি আমাদের জন্য ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। আমি বিশ্বব্যাংককে আমাদের মানবিক প্রচেষ্টায় যোগদানের জন্য এবং রোহিঙ্গা ও তাদের সম্প্রদায়ের জন্য ৫৯০ মিলিয়ন ডলার অনুদানের জন্য ধন্যবাদ জানাই।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস এবং সংস্থাটির সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌসিক বসু। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশের অংশীদারত্বের ৫০ বছর উপলক্ষ্যে সবার সঙ্গে যোগ দিতে পেরে আমি আনন্দিত। আমি প্রেসিডেন্ট মালপাসকে তার আমন্ত্রণ ও আতিথেয়তার জন্য ধন্যবাদ জানাই। বিশ্বব্যাংকে অনেক বাংলাদেশিকে নিয়োজিত দেখে আমি আনন্দিত।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংক একটি নেতৃস্থানীয় উন্নয়ন অংশীদার হিসাবে বাংলাদেশকে ধারাবাহিকভাবে সহায়তা করে আসছে। সংস্থটি চলমান আইডিএ কর্মসূচির অধীনে বাংলাদেশের জন্য বর্তমান বৈদেশিক সহায়তার প্রায় ৩২ শতাংশ অবদান রাখে।
তিনি বলেন, এখানে আমার উপস্থিতি এই ইঙ্গিত দেয় যে আমরা বিশ্বব্যাংকের প্রতি আমাদের আস্থা বজায় রেখেছি। আগামী দুই দশকে আমাদের সাফল্য নির্ভর করবে সম্মিলিত সক্ষমতা এবং ন্যায়সংগত ও টেকসই উপায়ে উদীয়মান চ্যালেঞ্জগুলো অতিক্রম করার প্রচেষ্টার ওপর।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত দেড় দশকে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলাদেশ বিনামূল্যে গণটিকাদানের মাধ্যমে সফলভাবে কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলা করেছে।
নিজস্ব সম্পদে পদ্মা বহুমুখী সেতুর সমাপ্তি এবং গত বছর এর উদ্বোধন সম্ভবত আমাদের সহনশীলতা ও সাফল্য অর্জনের সেরা উদাহরণ। শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ আজ বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে।
আমাদের জিডিপি এখন ৪৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আমাদের অর্থনীতি গত এক দশকে গড়ে ৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মহামারির ঠিক আগে এটি ৮.১৫ শতাংশে পৌঁছেছিল। এর ফলে ২০২২ সালে মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলারে পৌঁছে।
তিনি বলেন, ২০২২ সালে বাংলাদেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার ১৮.৭ শতাংশে নেমে এসেছে, যা ২০০৬ সালে ৪১.৫ শতাংশ ছিল। সামাজিক সুরক্ষার জন্য আমরা জাতীয় বাজেট বরাদ্দ ৪০ গুণ বাড়িয়েছি, যা জিডিপির ২.৫ শতাংশ।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা বিনা খরচে সব গৃহহীন ও ভূমিহীন মানুষকে আবাসন প্রকল্পের আওতায় আনার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে প্রায় ৫০ লাখ মানুষকে বিনা খরচে বাড়ি দিয়েছি এবং আয় সংস্থানমূলক দক্ষতা ও সহায়তা দিয়েছি। তিনি বলেন, আমরা প্রতিটি বাড়ির দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা এবং বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার আঞ্চলিক দেশগুলোর তুলনায় বেশি। জাতীয় জিডিপিতে নারীদের গৃহস্থালির কাজ প্রতিফলিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বাংলাদেশকে একটি আঞ্চলিক সংযোগ, বিমান ও লজিস্টিক হাব হিসাবে গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দিয়েছি। দেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি, যা ২০৩০ সালের মধ্যে আনুমানিক ১০ মিলিয়ন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।
শেখ হাসিনা বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার জন্য আমরা পরবর্তী রূপকল্প চালু করেছি; যার লক্ষ্য ডিজিটালভাবে নাগরিকদের ক্ষমতায়িত করা, চেহারাহীন সরকারি সেবা প্রদান, নগদ অর্থ লেনদেনহীন অর্থনীতি এবং অধিকারভিত্তিক ন্যায়সংগত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা।
বাংলাদেশে মার্কিন ব্যবসায়ীদের বড় বিনিয়োগ চান প্রধানমন্ত্রী : বাংলাদেশে মার্কিন ব্যবসায়ীদের ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুধু মার্কিন বিনিয়োগকারীদের জন্য ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ রাখার প্রস্তাবও তিনি পুনর্ব্যক্ত করেন।
মঙ্গলবার ‘ইউএস-বাংলাদেশ ইকোনমিক পার্টনারশিপ : শেয়ার্ড ভিশন ফর স্মার্ট গ্রোথ’ শীর্ষক উচ্চ পর্যায়ের এক্সিকিউটিভ বিজনেস গোলটেবিলের মূল বক্তব্য উপস্থাপনের সময় তিনি এ আহ্বান জানান।
মার্কিন ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, আমি আপনাদের আমাদের নবায়নযোগ্য জ্বালানি, জাহাজ নির্মাণ, অটোমোবাইল, ফার্মাসিউটিক্যালস, হালকা ও ভারী যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক সার, আইসিটি, সামুদ্রিক সম্পদ এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম ইত্যাদিসহ গতিশীল ও সম্ভাবনাময় খাতগুলোতে বিনিয়োগ করার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
তিনি ইউএস-বাংলাদেশ আইটি কানেক্ট পোর্টাল (us.itconnect.gov.bd) উদ্বোধন করেন। ইউএস চেম্বার অব কমার্স ওয়াশিংটন, ডিসির গ্রেট হলে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ইউএস-বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিল।
প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন, যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিল দুই বন্ধুপ্রতিম দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
তিনি বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আমাদের যাত্রায় অংশীদার হিসাবে আমাদের সঙ্গে থাকার জন্য আমি আপনাদের আহ্বান জানাচ্ছি।