ভ্রমণ ডেস্ক :
পাহাড়ের উপর ভুটানের রাজধানী থিম্পু (Thimpu), যা সমদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৭,৩৭৫ থেকে ৮,৬৮৮ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। সুন্দর শহর হিসেবে পরিচিত এই শহরের চারপাশের পাহাড়ি আঁকা বাঁকা রাস্তা ও ঠাণ্ডা হিমেল মনোমুগ্ধকর পরিবেশ এক অদ্ভুত ভালো লাগা তৈরি করে পর্যটকদের মনে। আর রংবেরঙ্গের বাড়িগুলো দেখলে মনে হয় যেন কোন শিল্পীর তুলিতে যত্ন করে আঁকা কোন ছবি। আর তাই এমনই ছবির মতো শহর থিম্পু দেখার জন্য প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক পাড়ি জমায় এই শহরে।
থিম্পুর দর্শনীয় স্থান
থিম্পুর পাহাড়ি রাস্তায় নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে রাস্তার দু’পাশে আছে অসংখ্য পুলিশ চেক পোস্ট। আর তাই থিম্পু শহরে ঢোকার প্রবেশ পথেও প্রথমেই চেকপোস্ট চোখে পড়বে। এছাড়াও চোখে পড়বে রাস্তার ধারে বিশাল মনোরম লেক যা দেখলেই মনটা শান্ত হয়ে যায়। থিম্পু শহরের ভিতরে আছে দেখার মতো অনেক কিছু, এর মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য হলঃ
বুদ্ধ দর্দেনমা স্ট্যাচু : পাহাড়ের উপর ৫১.৫ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট বিশাল এক স্ট্যাচু যা ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি ও সোনার প্রলেপ দিয়ে আবৃত। বুদ্ধ দর্দেনমা (Buddha Dordenma) স্ট্যাচু শহরের যে কোন জায়গা থেকে দেখা যায়।
ন্যাশনাল মেমোরিয়াল কর্টেন : থিম্পুর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একটি বড় বৌদ্ধ উপসনা কেন্দ্র (national memorial chorten) এর এন্ট্রি ফি ৩০০ টাকা (স্টুডেন্ট আইডি কার্ড দেখালে ১৫০ টাকা)। ভুটানের ৩য় রাজা জিগমে দরজির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ১৯৭৪ সালে এই স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়। এখানে অনেক পেইন্টিং ও স্ট্যাচু আছে। রয়েছে হাজার হাজার কবুতর।
সিটি ভিউ পয়েন্ট : এখান থেকে থিম্পু শহরটা পুরো ঠিকমতো দেখা যায়। এছাড়াও সুন্দর, ছিমছাম গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ ভুটানের রাজা রানীর কিংস প্যালেস বা ডিচিন চোলিং প্যালেস চোখে পড়ে এখান থেকে।
সিমতোখা ডিজং(Simtokha Dzong) : এখানে আছে রিগনে স্কুল অফ মোনাস্টিক স্টাডিস, ফ্রেশকো ও স্টেট কার্ভিং।
থিম্পু জং: ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই থিম্পু জং এ দেখা মিলবে দ্যা ন্যাশনাল এসেম্বলি, ভুটানের রাজার থ্রোন রুম ও সরকারি নানা ডিপার্টমেন্ট।
ন্যাশনাল তাকিন সংরক্ষিত চিড়িয়াখানা : ছোট একটি চিড়িয়াখানা, এখানে ভুটানের জাতীয় পশু তাকিন আছে। এন্ট্রি ফি লাগবে ৩০০ রুপি।
তাসিছ ডিজং বা থিম্পু ডিজং: এটাকে বলা হয় জেলা অফিস (district office)। এর মাঝে একটি বৌদ্ধ উপাসনালয় আছে।
পার্লামেন্ট হাউস: তাসিছ ডিজং বা থিম্পু ডিজং-এর পাশেই পার্লামেন্ট হাউজ। অবিকল ছবির মতো সুন্দর একটি ভবন। সবুজের মাঝে লালচে খয়েরি রঙে গড়া এক সুন্দর স্থাপত্য, যা সহজে নজর কাঁড়ে সবার।
এছাড়াও আছে থিম্পু ক্লক টাওয়ার, ফার্মারস মার্কেট, রাজপ্রাসাদ, ন্যাশনাল লাইব্রেরি এবং বিবিএস টাওয়ার এর মতো দেখার কিছু জায়গা।
থিম্পু বেড়ানোর উপযুক্ত সময়-থিম্পু অর্থাৎ ভুটান (Bhutan) ভ্রমণের সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হচ্ছে সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাস। আবহাওয়া ও ভুটানের প্রকৃতির সৌন্দর্য সব বিবেচনা করে এই তিন মাস বেড়ানোর জন্যে ভাল সময়।
কিভাবে যাবেন থিম্পু “ভুটান ” ভুটান যেতে পারেন বাসে, বিমানে বা রেলপথে। বাসে যাওয়ার ক্ষেত্রে, ঢাকা থেকে নাবিল, মানিক পরিবহন, শ্যামলী, এস আর ও শাহ ফতেউল্লাহর বাস সার্ভিস আছে। কল্যাণপুর থেকে রাত ৯ টায় ও আরামবাগ থেকে রাত ৮ টায় শ্যামলীর বাস ছাড়ে।
ঢাকা থেকে বুড়িমারি সীমান্তে পৌঁছে ইমিগ্রেশন অফিসে যেতে হবে। সেখান থেকে দরকারি কাজ শেষ হলে ভারতের চ্যাংড়াবান্ধা ইমিগ্রেশন অফিসে যেতে হবে পায়ে হেঁটে। ওখানের কাজ শেষ হলে আবার শ্যামলীর বাস বা যেকোনো ট্যাক্সি ভাড়া করে যেতে পারেন জয়গাঁও ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন অফিস।
ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন অফিস থেকে সব টিকঠাক থাকলে এক্সিট সিল লাগিয়ে দিবে কোন ঝামেলা ছাড়া। তারপর ভুটানের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। ফুন্টশোলিং-এ অবস্থিত ভুটান ইমিগ্রেশন অফিস থেকে on arrival ভিসা নিতে হবে। এই ভিসা দিয়ে শুধু থিম্পু ও পারো তে ভ্রমণের অনুমতি পাওয়া যাবে। অন্য কোথাও ভ্রমণের ক্ষেত্রে সেই পার্মিশন থিম্পু থেকে নিতে হবে।
ফুন্টশোলিং থেকে থিম্পুর দূরত্ব ১৪৭.৩ কিলো আর সময় লাগে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা। ফুন্টশোলিং থেকে থিম্পু যেতে পেরেন ট্যাক্সি বা জীপে করে। নিজেরা গ্রুপ করে ট্যাক্সি বা জীপ নিয়ে থিম্পু গেলে আপনার পছন্দমত জায়গায় নেমে দেখতে ও ছবি তুলতে পারবেন।
তবে বিমান পথে বেশ আরামে যাওয়া যায় ভুটান। যেহেতু সার্কভুক্ত দেশ, তাই আলাদা ভিসার কোন দরকার নেই। ড্রুক এয়ার ও রয়্যাল ভুটান এয়ারলাইন্স চলাচল করে ঢাকা থেকে ভুটানের পারো নগরীতে। পারোতে ভুটানের একমাত্র বিমান বন্দর। তবে বিমানে ভ্রমণের ক্ষেত্রে খরচ বাই রোডের চেয়ে বেশি হবে।
রেলপথের ক্ষেত্রে, ভারতের সীমান্তও শহর জয়গাঁও থেকে নিউ জলপাইগুড়ির হাসিমারাতে যেতে হবে। হাসিমারা থেকে ভুটানে যাওয়ার ট্রেন পাওয়া যাবে।
ট্রানজিট ভিসা : বাই রোডে ভুটানে যাওয়ার জন্য সবার প্রথমে ভারতীয় ট্রানজিট ভিসার প্রয়োজন। এই ভিসার জন্য আবেদন ঢাকার গুলশান বা অন্য কোন শাখাতেও করা যায়। তবে টিকেট আগেই করে রাখতে হয় কারন ট্রানজিট ভিসার আবেদনের সাথে ভুটানে যাবার টিকেট জমা দিতে হয়।
থিম্পু ভ্রমণ খরচ: ৪-৫ জনেরগ্রুপ করে গেলে জনপ্রতি খরচ পড়বে ১৭-১৯ হাজার টাকা। আর শপিং করলে আরও একটু বেশি খরচ পড়বে। সেটা যার যার শপিং এর উপর নির্ভর করে। তাই ভুটানে একক বা দুজনে না গিয়ে কোনো ট্র্যাভেল গ্রুপের সাথে ৪/৫ জন বা ৭/৮জন মিলে গেলে ভালো, সেইক্ষেত্রে যাতায়াত, থাকা ও খাওয়ার খরচ শেয়ার করলে মোটের উপর জনপ্রতি খরচ অনেক কম হবে।
কোথায় থাকবেন: ভুটানের থিম্পুতে থাকার জন্য আগে থেকেই হোটেল বুকিং না দিয়ে ওখানে গিয়ে বুকিং দিলে ভালো, সেই ক্ষেত্রে দামাদামি করে হোটেলে থাকার সুযোগ থাকে। এখানে সব রকমেরই হোটেল পাবেন। সর্বনিম্ন ১৮০০ রূপি থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার রূপি পর্যন্তও হোটেল রুম ভাড়া পাবেন। কিছু বিশেষ উল্লেখযোগ্য হোটেলের মধ্যে- Hotel River View, Pemaling Villa, Hotel Vara, Hotel Dralha, Hotel riverside, Hotel DrukYul, Khamsum Inn। এই হোটেল গুলোতে ডাবল রুমের ভাড়া ৩৬০০- ৪১০০ টাকা পর্যন্ত।
কি খাবেন: এখানের স্বাভাবিক সাধারন খাবারগুলোও বেশ মজার। এখানকার যেকোনো হোটেলের ঘন ডাল, সব্জি, মাছ, মাংসখেতে ভালো লাগবে। এছাড়াও ভিন্ন ধরনের খাবারের মধ্যে ‘এমা দাতসি’, ‘কেওয়া দাতসি’, ‘জাশামারো’, ‘ফাকশাপা” আর মোমো খেলে মজা পাবেন। তবে হ্যাঁ, এই খাবার গুলো অবশ্যই লাল চালের ভাতের সাথে খেতে হবে।আরও কিছু মজার খাবার হল- সুজা (মাখন ও লবন দিয়ে বানানো চা), থিম্পুর হোটেল ৮৯ এর পুরি ও সব্জি, Hotel choephel Norkri এর ডাল, সব্জি বা যেকোনো খাবার।
কেনাকাটা: ভুটানের লোকাল মার্কেটে কেনাকাটা করতে পারেন। এছাড়াও Farmers’s Holiday Market এ পাবেন ভুটানের নানা জিনিস। তবে শুধু মাত্র শনি ও রবি বার গেলেই এই মার্কেটের দেখা মিলবে।এখানকার বিভিন্ন হস্তশিল্পের দোকান থেকে ভুটানিদের হাতে বোনা কাপড়, কাঠের জিনিসপত্র,পাথরের জিনিসপত্র কিনতে পারেন।
কিছু টিপস: আগস্ট থেকে অক্টোবর মাস অর্থাৎ শীতের আগের সময়টা ভুটানে যাওয়ার জন্য ভালো সময়।
ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ হলে টাকা বা ডলার রুপিতে এক্সচেঞ্জ করে মানি রিসিট সাথে রাখবেন।
বাংলাদেশীদের ভুটানিরা খুব সম্মান করে, আর তাই শুধু পাসপোর্টে সিল লাগানোর জন্য অনেক দিনের ভিসা নেওয়া সত্ত্বেও শুধু মাত্র এক দুই দিন পরেই দেশে ফিরে আসবেন না, এটা করা অসম্মানজনক, যেটা করে অনেক বাঙ্গালিই দেশের ও নিজের সম্মান ক্ষুন্ন করে। ভুটানে সব দোকান-পাট ৮.৩০-৯ টার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। তাই তার আগেই কেনাকাটা ও ঘুরাঘুরি শেষ করে হোটেলে ফিরতে হবে।
ভারতীয় ট্রানজিট ভিসায় ভারতে যদি বেশি সময় অবস্থান করতে হয় তাহলে সেই ক্ষেত্রে দার্জিলিং ঘুরে আসতে পারেন।
ভুটানে ট্যাক্সি বাদে পাবলিক বাসে ঘুরলে খরচ কিছুটা কম হবে।
ভুটানে সরকারী ছুটির দিনগুলো বাদ দিয়ে ভ্রমণে গেলে ভালো।
সারাদিনের জন্য ট্যাক্সি ভাড়া করে শহরে ঘুরতে পারেন। এই ক্ষেত্রে ভুটানি বা
নেপালি কেউ ড্রাইভার হিসেবে বেশ ভালো ও মিশুক। তবে গাড়ি ভাড়া করার ক্ষেত্রে অবশ্যই দামাদামি করে নিবেন।
ভুটান পরিষ্কার পরিছন্ন দেশ তাই যেখানে সেখানে ময়লা ফেলা থেকে বিরত
থাকুন।
ভুটান শতভাগ ধূমপান মুক্ত দেশ। তাই কারো ধূমপানের অভ্যাস থাকলে প্রকাশ্যে করা কখনই উচিৎ হবে না। হোটেলের স্মোকিং জোনে ধূমপান করা ভালো।
যেকোনো ভ্রমণের ক্ষেত্রে সঙ্গে ফাস্ট এইড বক্স রাখা ভালো।