নিজস্ব প্রতিবেদক :
বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় তাঁর স্ত্রী আয়শা সিদ্দিক ওরফে মিন্নিসহ ছয়জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মামলার বাকি চার আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে। বুধবার বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামান এ রায় ঘোষণা করেন।
এক নজরে রিফাত শরীফ হত্যা মামলাটিঃ
স্ত্রী আয়শা মিন্নিসহ ৬ জনের মৃত্যুদণ্ডঘটনা ঘটে ২০১৯ সালের ২৬ জুনমামলা হয় পরের দিন ২৭ জুন, বরগুনা থানায়মামলার বাদী রিফাতের বাবা আবদুল হালিম শরীফমামলার তদন্তকারী অফিসার – হুমায়ুন কবির, পুলিশ ইন্সপেক্টরমামলার প্রাপ্তবয়স্ক আসামি ১০ জন!মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন ৭৬ জনবিচারকাজ শেষ হয় ২০২০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর
অপ্রাপ্তবয়স্ক আসামীদের বিচার জুবিন্যাল আদালতে হবে!
এ মামলা তদন্ত করেন বরগুনা সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাে. হুমায়ুন কবির। প্রায় দুই মাস তদন্ত শেষে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর তিনি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযােগপত্র দাখিল করেন। এই অভিযােগপত্রে হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য বেরিয়ে আসে।
অভিযােগপত্রে বলা হয়, গ্রেপ্তার হওয়া মিন্নির বিরুদ্ধে অভিযােগ তদন্ত কালে দেখা যায়, রিফাত বরগুনা থানা এলাকায় ডিশলাইনের ব্যবসা করতেন। ১ নম্বর আসামি নয়নবন্ড ও রিফাত শরীফ একসঙ্গে বরগুনা জিলা স্কুলে পড়ালেখা করেছেন। একসঙ্গে পড়ালেখার সুবাদে তাঁদের উভয়ের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।

২০১৭ সালে রিফাতের সঙ্গে আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির প্রেম হয়। পরে রিফাতের মাধ্যমে তাঁর বন্ধু নয়নবন্ডের সঙ্গে মিন্নির পরিচয় হয়। ২০১৮ সালে রিফাত শরীফ মােটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়ে দেড় মাস চিকিৎসাধীন ছিলেন। এ সময়ে মিন্নির সাথে নয়নবন্ডের নতুন প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ২০১৮ সালের ১৫ অক্টোবর নয়নবন্ডের বাড়িতে নয়নবন্ডের সঙ্গে মিন্নির গােপনে বিয়ে হয়। সাক্ষী রায়হানুল ইসলামের মাধ্যমে কাজী আনিচুর রহমান পাঁচ লাখ টাকার দেনমােহরে তাঁদের বিয়ে সম্পাদন করেন। বিয়েতে নয়নবন্ডের পক্ষে সাক্ষী ছিলেন আসামি রাকিবুল হাসনাত ফরাজী এবং মিন্নির পক্ষে সাক্ষী ছিলেন প্রতিবেশী ও বন্ধু মাে. সাইফুল ইসলাম মুন্না। মিন্নি বিয়ের বিষয়টি গােপন রাখেন এবং রিফাতের সঙ্গে পুরােনাে প্রেমের সম্পর্ক অব্যাহত রাখেন। কিছুদিন পর আগের একটি মামলায় নয়নবন্ডকে কারাগারে পাঠান আদালত। তখন মিন্নি নয়নবন্ডকে তালাক না দিয়েই ২০১৯ সালের ২৬ এপ্রিল রিফাতের সঙ্গে পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।



নয়নবন্ড মিন্নির কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়ে ওই দিন বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে বরগুনা সরকারি কলেজের শহীদ মিনারে আসামিদের সঙ্গে বৈঠক করে রিফাতকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। একই সঙ্গে আসামিদের সকাল ৯টায় কলেজের সামনে উপস্থিত থাকতে বলা হয়।
হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, ২৬ জুন সকালবেলা মিন্নি কলেজের সায়েন্স বিল্ডিংয়ের সামনে গিয়ে আসামি রিফাত ফরাজী, রাব্বি আকন, রিফাত হাওলাদারের সঙ্গে দেখা করেন। আসামিদের খালি হাতে দেখে মিন্নি বিস্ময় প্রকাশ করেন এবং রিফাত ফরাজীর কাছে জানতে চান, তারা খালি হাতে কেন এবং রিফাতকে কী দিয়ে মারবে? ওই সময় মিন্নিকে নিতে কলেজের গেটে আসেন রিফাত। তখন মিন্নি বিফাতের সঙ্গে কলেজের গেটের সামনে রাখা মােটরসাইকেলর কাছে যান। কিন্তু পূর্বপরিকল্পনামাফিক গেটের আশপাশে থাকা আসামিদের সুযােগ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এবং সময়ক্ষেপণ করার জন্য মিন্নি পুনরায় কলেজে ফিরে যান। এ সময় রিফাত মিন্নিকে ফেরাতে পেছনে পেছনে কলেজের দিকে যান। তখন রিফাতকে হামলা করার জন্য আসামিদের ইশারা দেন মিন্নি। তখন আসামি রিফাত ফরাজীসহ অন্যরা মিন্নির স্বামীকে জাপটে ধরে মারতে মারতে টেনেহিঁচড়ে ক্যালিক্স একাডেমির সামনে নিয়ে যেতে থাকেন। এ সময় মিন্নি স্বাভাবিকভাবে তাঁদের পেছনে হেঁটে যান।

অভিযােগপত্রে আরাে উল্লেখ করা হয়, আসামি রিফাত ফরাজী দৌড়ে গিয়ে পূর্ব পাশের দেয়ালসংলগ্ন গলির মুখে জনৈক নুরুল হকের বারান্দার টিনের চালের ওপরে রাখা ব্যাগের মধ্য থেকে দুই হাতে দুটি বগি দা নিয়ে আসেন। একই সময় আসামি টিকটক হৃদয় ও রিফাত হাওলাদার দৌড়ে গিয়ে দুটি লাঠি নিয়ে আসেন। আসামি রিফাত ফরাজী একটি দা রাস্তার ওপরে রেখে দিয়ে
রিফাত শরীফকে এলােপাতাড়ি কোপাতে থাকেন। এ সময় আসামি নয়নবন্ড আসামি রিফাত ফরাজীর হাত থেকে বগি দা নিয়ে রিফাত শরীফকে এলােপাতাড়ি কোপাতে থাকেন। আসামি রিফাত ফরাজী তখন রাস্তার ওপরে রাখা অন্য বগি দাটি নিয়ে পুনরায় রিফাত শরীফকে এলােপাতাড়ি কোপাতে থাকেন। আসামি রিশান ফরাজী তখনাে রিফাত শরীফকে জাপটে ধরে রাখেন। আসামি টিকটক হৃদয় ও রাকিবুল হাসান রিফাত লাঠি হাতে হত্যাকাণ্ড নির্বিঘ্ন করার জন্য পাহারা দেন। ওই সময় আসামি মোহাইমিনুল ইসলাম, সিফাত, মাে. নাজমুল হাসান, প্রিন্স মােল্লা, আবু আবদুল্লাহ রায়হান, আল কাইয়ুম রাব্বি আকন, নাঈম, অলি উল্লাহ অলি, রাকিবুল হাসান নিয়ামত, জয় চন্দ্র সরকার ওরফে চন্দন, মাে. হাসান, মারুফ বিল্লাহ ওরফে মহিবুল্লাহ, মাে. মুসা, মারুফ মল্লিক ও রাতুল সিকদার জয় পাহারা দেন। আসামি মিন্নি শুরুতে স্বাভাবিক থাকলেও পরে দায় এড়ানাের জন্য কৌশলে রিফাতকে বাঁচানাের অভিনয় করেন এবং শুধু নয়ন বন্ডকে নিবৃত করার চেষ্টা করেন। এরপর লােকজন জড়াে হলে তাঁরা পালিয়ে যান।
অভিযােগপত্রে বলা হয়, মিন্নি ঘটনার দায় এড়াতে যেহেতু স্বামীকে বাঁচানাের অভিনয় করেন, এ কারণে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আসামিরা মিন্নিকে আঘাত করেনি। এ সময় রক্তাক্ত রিফাত শরীফ একাই রিকশাযােগে হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হন। মিন্নিকে তখন রাস্তায় পড়ে থাকা তাঁর ভ্যানিটি ব্যাগ ও জুতা কুড়াতে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। পরে মিন্নি রিকশায় করে রিফাত শরীফের সঙ্গে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে যান। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর মুমূর্ষু রিফাতকে বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করতে বলেন চিকিৎসকেরা। তখন মিন্নি তাঁর জামাকাপড় রক্তে ভেজা, তাই বরিশাল যাওয়া সম্ভব নয়
এই অজুহাত দেখিয়ে নিজের বাবার বাড়িতে চলে যান এবং হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি নয়নবন্ডকে মোবাইল ফোনে দ্রুত নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। (মিন্নির মোবাইল রেকর্ডে প্রাপ্ত)

আসামী মিন্নি রিফাত ফরাজী রাশিদুল হাসান রিশান, মাে. হাসান ও টিকটক হৃদয় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারার স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এ ছাড়া ১৬১ ধারায় রেকর্ড করা সাক্ষীদের জবানবন্দি, বস্তুগত প্রমাণ, সিসিটিভি ফুটেজ, সিডিআর এবং সার্বিকভাবে পারিপার্শ্বিক অবস্থাগত সাক্ষ্যে প্রাপ্ত তথ্যে আসামি মিন্নির বিরুদ্ধে রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার বিষয়টি প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে।অভিযােগপত্রে শেষ পাতায় তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, আসামিদের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ জন এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ জন। তার মধ্যে প্রধান আসামি নয়নবন্ড ২০১৯ সালের ২ জুলাই পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। এ কারণে তাঁকে মামলা থেকে অব্যাহতিদানের প্রার্থনা করলাম। অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার সত্যতা প্রাথমিকভাবে পাওয়া গেছে।
তথ্যসুত্রঃ – তদন্তকারী অফিসার এবং কপস -COPS