সলিল চক্রবর্তীকে দুই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ

সলিল চক্রবর্তীকে দুই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

১৯৭৮ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তির আবেদন করেন সলিল কান্তি চক্রবর্তী। প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করার পর তিনি ওই কোর্সে ভর্তির জন্য বিবেচিত হন।

কিন্তু তৎকালীন কলেজ কর্তৃপক্ষ তার কাগজপত্র জাল উল্লেখ করে তাকে ভর্তি প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেয়। এরপর বিষয়টি গড়ায় আদালতে। আর এভাবেই কেটে যায় ৪৪টি বছর। এখন সেই শিক্ষার্থীর বয়স ৬০ বছরের বেশি। ফলে তিনি আর চিকিৎসক হতে পারেননি।

এ অবস্থায় বর্তমানে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তির শারীরিক সামর্থ্য না থাকায়, সলিল কান্তি চক্রবর্তীকে দুই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষকে এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বিষয়টি জাগো নিউজকে নিশ্চিত করেছেন সলিল কান্তির আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. ইউনুছ আলী আকন্দ। তবে কতদিনের মধ্যে মেডিকেল কর্তৃপক্ষকে এই টাকা পরিশোধ করতে হবে তা নিশ্চিত করেননি আইনজীবী। তিনি বলেন, রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর বলা যাবে কতদিনের মধ্যে টাকা দিতে হবে।

এদিকে এ সংক্রান্ত বিষয়ে আদালতের আদেশ পালন না করায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মহাপরিচালক (ডিজি), স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে করা আদালত অবমাননার অভিযোগের রুল শুনানির জন্য রয়েছে।

জানা গেছে, সলিল কান্তি চক্রবর্তী ১৯৭৬ সালে এসএসসি পাস করেন। আর এইচএসসি শেষ করেন ১৯৭৮ সালে। এরপর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ১৯৭৮-৭৯ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তির আবেদন করেন তিনি। প্রয়োজনীয় সব শর্ত পূরণ করার পর তিনি ওই কোর্সে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হন।

কিন্ত মেডিকেল কলেজের বাছাই কমিটি সলিলের এসএসসি-এইচএসসির নম্বরপত্রসহ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র জাল উল্লেখ করে তাকে ভর্তি প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেয়। সেই সঙ্গে ভর্তি প্রক্রিয়ায় জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়ায় তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার সুপারিশ করা হয়।

এরপর সলিল কান্তি চক্রবর্তী বিশেষ বিবেচনায় ভর্তির জন্য বিভিন্ন সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের দপ্তরে আবেদন করেন।

তার এমন এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৮ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সলিল কান্তি চক্রবর্তীকে চিঠি দিয়ে জানায়, তার বিরুদ্ধে করা জালিয়াতির অভিযোগটি দুর্নীতি দমন ব্যুরোতে তদন্তাধীন। তদন্ত শেষে সংস্থাটি জানালে ভর্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।

এরপর ভুয়া কাগজপত্র তৈরির অভিযোগে ১৯৯৪ সালের ২ আগস্ট সলিল কান্তি চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে বান্দরবান থানায় মামলা হয়। মামলায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় দণ্ডবিধির ৪০৬, ৪২০, ৪৬৮ ও ৪৭১ ধারার।

পঞ্চম দফায় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন হওয়ার পর, ১৯৯৮ সালে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। ওই বছরের ১ সেপ্টেম্বর সলিল কান্তি চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন বান্দরবানের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালত।

তবে ২০০০ সালে বান্দরবানের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শাহ মোকসেদ আলী মামলা থেকে সলিল কান্তি চক্রবর্তীকে বেকসুর খালাস দিয়ে রায় দেন। তবে রায়ে তার ভর্তির বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। এ রায়ের পর ২০০১ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ভর্তির সুপারিশ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুই পরিচালক ও স্বাস্থ্য সচিবকে তিনবার চিঠি দেন সলিল কান্তি চক্রবর্তী।

তাতে কাজ না হওয়ায়, ২০০৩ সালের ২৪ জুন সলিল কান্তি চক্রবর্তী ভর্তির জন্য স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর কাছে লিখিত আবেদন করেন। একের পর এক আবেদনের পর ২০০৪ সালের ১৭ মে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে সলিলের ভর্তির বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে চিঠি দেন। তারপরও পদক্ষেপ না নেওয়ায় ওই বছর ২৮ অক্টোবর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের দপ্তরে আবেদন করেন সলিল।

এতেও কাজ না হওয়ায় ২০০৫ সালের ১৫ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠান সলিল। নোটিশে ১৫ দিনের মধ্যে তার ভর্তির পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করা হয়। এতে সাড়া না পেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন তিনি।

প্রাথমিক শুনানির পর সলিল কান্তি চক্রবর্তীর ভর্তির বিষয়ে রুল জারি করেন আদালত। রুলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষে সলিলকে ভর্তি করতে বিবাদীদের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না এবং তার ভর্তির ক্ষেত্রে বিবাদীদের ইচ্ছাকৃত বিলম্বের জন্য তাকে কেন আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়।

ওই রুলের চূড়ান্ত শুনানির পর ২০০৭ সালে রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। রায়ে ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষে তাকে ভর্তি করাতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

এরপর ওই বছরই হাইকোর্টের এ রায় স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ওই আবেদনের শুনানির পর হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেন চেম্বারজজ আদালত। রায় স্থগিত থাকা অবস্থায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে নিয়মিত লিভ-টু আপিল করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সবশেষ সেই আপিল খারিজ করে ক্ষতি পূরণের রায় দিলেন সর্বোচ্চ আদালত। রায় অনুযায়ী এখন সলিল কান্তি চক্রবর্তীকে দুই কোটি টাকা দিতে হবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজকে।

Loading

পোষ্টটি প্রয়োজনীয় মনে হলে শেয়ার করতে পারেন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!