২২ বছরে সুন্দরবনে ২৪ বার আগুন, যেসব কারণ বেরিয়েছে তদন্তে
- আপডেটঃ ০৫:২১:২২ অপরাহ্ন, সোমবার, ৬ মে ২০২৪
- / ৯৬০ বার পঠিত
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগে ২২ বছরে ২৪ বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবার এর কারণ অনুসন্ধান ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তবে সেসব তদন্ত প্রতিবেদন ও দুর্ঘটনা এড়াতে করা সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হতে দেখা যায়নি। ফলে নিয়মিত বিরতিতে আগুন লাগছেই।
বনে আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধানে প্রতিবার করা হয় তদন্ত কমিটি। তবে বনের সুরক্ষায় তদন্ত কমিটির সুপারিশগুলো থেকে যায় ফাইলবন্দি। বন বিভাগের হিসাব মতে, কেবল শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জের বিভিন্ন স্থানে ২৩ বার লাগা আগুনে পুড়েছে ৭১ একর ৬৬ শতাংশ বনভূমি। সর্বশেষ শনিবার আগুন লাগার ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়নি।এখনো সুন্দরবনে জ্বলছে আগুন। রোববার রাত ১টা পর্যন্ত শুধু বন বিভাগের লোকজন আগুন নিয়ন্ত্রণে পাম্পের মাধ্যমে পানি দেয়।
প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমির হোসেন চৌধুরী রোববার বিকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী সমন্বয়ে দুটি টিম করে রাতেও আগুন লাগার স্থানগুলোতে পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। ফলে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে। সোমবার সকাল ৭টা থেকে বন বিভাগের সঙ্গে ফায়ার সার্ভিস অন্যান্য বাহিনীর লোকজন অতিরিক্ত সতর্কতার অংশ হিসেবে যেসব স্থানে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে সেখানে পানি দিচ্ছে।
চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক রানা দেব জানান, রাতে ভালো আগুন দেখা যায়, তাই আগুন দেখে দেখে পানি দেওয়ায় পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এসেছে সুন্দরবনের আগুন। এখন পর্যবেক্ষণে রেখে আরও দু’একদিন পানি দেওয়া হবে। শনিবার বিকালে সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের আমুর বুনিয়া এলাকায় আগুনের সূত্রপাত হলে দুই কিলোমিটারের অধিক এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি প্রথমবারের মতো আকাশপথে হেলিকপ্টারে করে পানি ছিটানো হয়।
বনে আগুন লাগার বিষয়ে জানতে চাইলে শরণখোলা সুন্দরবন রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম আকন বলেন, সুন্দরবনের যে স্থানে আগুন লেগেছে তা লোকালয় থেকে অনেক দূরে। ধারের কাছে কোনো বসতি নেই। বনের ওই স্থানে বিভিন্ন গাছে মৌচাক আছে এবং মধু সংগ্রহের জন্য সেখানে মৌলদের যাতায়াত রয়েছে। তবে সঠিক কি কারণে আগুন লেগেছে তা বলা মুশকিল। তবে এর আগে বনে মধু সংগ্রহকারী মৌয়ালদের ফেলে দেওয়া ধোঁয়া সৃষ্টির জন্য মশাল থেকেও বনে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে।
সুন্দরবন নিয়ে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে কাজ করছেন সুন্দরবন সাংবাদিক ফোরামে সদস্য সচিব শেখ আহসানুল করিম। তিনি বলেন, বর্ষা মৌসুমে মাছ শিকারের সুবিধার্থে আসাধু জেলেরা পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগিয়ে বনের বিভিন্ন স্থান ফাঁকা করে ফেলে। পরবর্তী সময় তারা ওই স্থানে জাল পেতে মাছ ধরে। বিষয়টি অনেকটা ওপেন সিক্রেট হলেও কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। শুধু আগুনেই পুড়ছে না সুন্দরবন। বন্যপ্রাণী ও মৎস্য সম্পদ প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে চলছে একশ্রেণির চক্র। প্রতিবার আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধান ক্ষতি নিরূপণ ও ভবিষ্যতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়। তবে সেসব তদন্তের প্রতিবেদন ও দুর্ঘটনা এড়াতে করা সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হতে দেখা যায়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অগ্নিকাণ্ড এড়াতে বিভিন্ন সময় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের জোরালোভাবে তিনটি সুপারিশ করা হয়। এ তিনটি সুপারিশ হলো সুন্দরবনসংলগ্ন লোকালয়ের সঙ্গে মিশে যাওয়া নদী খাল খনন, অগ্নিকাণ্ড প্রবণ এলাকার প্রতি দুই কিলোমিটার পর পর ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করে নজরদারির ব্যবস্থা করা এবং ভোলা নদীর পাশ দিয়ে কাঁটাতার অথবা নাইলনের রশি দিয়ে বেড়া দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
এ বিষয়ে কথা হলে সেফ দ্যা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনকে আগুন থেকে রক্ষার জন্য লোকালয়সংলগ্ন নদীখাল খনন ও কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া জরুরি। একই সঙ্গে বন অপরাধীদের দৌরাত্ম্য রোধে বনরক্ষীদের তৎপরতা বৃদ্ধি করা ও অসাধু বন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক নুর আলম শেখ বলেন, এ আগুন লাগার দায়ভার কোনোভাবেই বন বিভাগ এড়াতে পারে না। আগুন লাগার জন্য দায়ী অসাধু মাছ ব্যবসায়ী ও বন কর্মকর্তারা। অদক্ষ মৌয়ালদের কারণে এ আগুন লেগেছে। এ ব্যাপারে বন বিভাগ ও সরকারকে আরও উদ্যোগী হয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে।
সুন্দরবন বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত ২২ বছরে খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জ এলাকায় কোনো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি। সর্বশেষসহ ২৪টি অগ্নিকাণ্ডের সবকটি ঘটেছে শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জ এলাকায়। প্রথমে ২০০২ সালে চাঁদপাই রেঞ্জের কটকা ও নাঙ্গলী এলাকায় আগুন লাগে। ২০০৫ সালে পচা কুরালিয়া ও গুটাবাড়িয়া সুতার খাল এলাকায় দুবার, ২০০৬ সালে তেরাবেকা, আমরবুনিয়া, খুরিয়াখালী, পচাকুড়ালিয়া ও ধানসাগর এলাকায় পাঁচবার, ২০০৭ সালে পচাকুড়ালিয়া, নাঙ্গলী ও ডুমুরিয়া এলাকায় তিনবার, ২০১০ সালে গুলিশাখালীতে, ২০১১ সালে নাঙ্গলীতে দুবার, ২০১৪ সালে গুলিশাখালীতে, ২০১৬ সালে পচাকুড়ালিয়া, নাঙ্গলী ও তুলা তলায় তিনবার, ২০১৭ সালে মাদ্রাসার সিলা এলাকায়, ২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ধানসাগার, ৩ মে শরণখোলা দাসের ভাড়ানি ও ৪ মে একই এলাকায় আবারও আগুন লাগে। সর্বশেষ শনিবার চাঁদপাই রেঞ্জের আমারবুনিয়া এলাকায় আগুন লাগে, যা এখনো জ্বলছে।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মো. নুরুল কবির বলেন, সুন্দরবনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা বনজীবীদের বিড়ি-সিগারেটের আগুনে অনেক সময় আগুন লাগে। এজন্য আমরা বনজীবী ও স্থানীয়দের সচেতন করেছি। সচেতনতামূলক কার্যক্রম এখনও অব্যাহত রয়েছে। তদন্ত কমিটির সুপারিশমতে, ওয়াচ টাওয়ার করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাঘ ও হরিণ হত্যার পাশাপাশি খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকার ও আগুন দস্যুদের হাত থেকে সুন্দরবন রক্ষায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট পেট্রোলিংসহ সব ধরনের পাহারা জোরদার করা হয়েছে।










