এয়ারপোর্টে অপেক্ষামান বাংলাদেশির হাজারো কর্মীর সর্বনাশ
- আপডেটঃ ০১:৩৬:২১ অপরাহ্ন, শনিবার, ১ জুন ২০২৪
- / ৬০৫ বার পঠিত
টিকিটের আশায় হাজারো কর্মীর সঙ্গে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের জহিরুল ইসলাম চার দিন ধরে আছেন ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। গতকাল শুক্রবার (৩১ মে) মালয়েশিয়া যাওয়ার শেষ দিনে টিকিট না পেয়ে জানালেন, তিনিসহ ছয়জনের কাছ থেকে সাড়ে ৫ লাখ টাকা করে নিয়েছে দালাল। কাঁদতে কাঁদতে জহিরুল বলেন, ‘মালয়েশিয়া যাতি জমি বেইচে টাকা দিছি। আমাগে শেষ কইরে দিয়েছে।’
সরকার নির্ধারিত ব্যয় ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা হলেও জহিরুলের মতো হাজারো কর্মী লাখ লাখ টাকা দিয়েও যেতে পারেননি মালয়েশিয়া। ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুরের ভাড়া সাধারণ সময়ে ২৫ হাজার টাকা হলেও, কর্মীর ঢলে ফ্লাইট সংকটে তা ওঠে পৌনে ২ লাখ টাকায়। তার পরও মেলেনি টিকিট। টিকিটের আশায় হাজারো কর্মী ভিড় করেন বিমানবন্দরে। ভাগ্যবানরা অশেষ ভোগান্তি সয়ে দেশ ছাড়েন। যারা টিকিট পাননি, তারা কান্নাকাটি করেন।
গত মার্চে মালয়েশিয়া সরকার ঘোষণা করেছিল, দেশটির ভিসা পাওয়া বিদেশি কর্মীদের ৩১ মের মধ্যে মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করতে হবে। প্রায় আড়াই মাস সময় পাওয়ার পরও ভিসা পাওয়া বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য পর্যাপ্ত ফ্লাইট নিশ্চিত করতে পারেনি সরকার। ফ্লাইট বৃদ্ধির ব্যবস্থা না করে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্মীদের প্রবেশের সময়সীমা বৃদ্ধির অনুরোধ করে। এতে সাড়া না দিয়ে গতকালই সব দেশের কর্মীদের জন্য শ্রমবাজার বন্ধ করে মালয়েশিয়া।পরবর্তী সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত বিদেশি কর্মী নিয়োগ করবে না দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটি। ফলে যেসব বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সি ও দালালকে টাকা দিয়েও স্বপ্নের দেশে যেতে পারেননি, তারা পড়েছেন অথৈ সাগরে।
তবে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং রিক্রুটিং এজেন্সির সংগঠন বায়রা টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করবে বলে আশ্বস্ত করেছে। যদিও অতীত অভিজ্ঞতায় এতে ভরসা পাচ্ছেন না কর্মীরা। যেমন, জহিরুলকে বিমানবন্দরে ফেলে পালিয়েছেন স্থানীয় আদম ব্যবসায়ী হারুনুর রশিদ। তিনি সাড়ে ৫ লাখ টাকা নিয়েছিলেন ১৪ মাস আগে। জহিরুলের মতো অনেককে মালয়েশিয়া পাঠাতে সরকারি সংস্থা জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ছাড়পত্র সংগ্রহ করে রিক্রুটিং এজেন্সি জে জি আলফালাহ ম্যানেজমেন্ট (নিবন্ধন নম্বর-১৮৬১)। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা কেন মালয়েশিয়া যেতে পারলেন না-জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পায়নি। এজেন্সি মালিক সোহেল রানাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।
কত কর্মী যেতে পারেননি: কত সংখ্যক কর্মী সব প্রক্রিয়া শেষেও মালয়েশিয়া যেতে পারেননি, তা গতকাল রাত ১০টা পর্যন্ত স্পষ্ট হয়নি। কেউ কেউ সংখ্যাটি ৩১ হাজার বললেও তা সঠিক নয়। গত বৃহস্পতিবার (৩০ মে) পর্যন্ত প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় ৫ লাখ ২৪ হাজার ৯৮৪ জনের নিয়োগ অনুমতি অনুমোদন করে। জনশক্তি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএমইটি ছাড়পত্র দিয়েছে ৪ লাখ ৯২ হাজার। সব নিয়োগ অনুমতির বিপরীতে ছাড়পত্র দেওয়া হয় না। ফলে ৩২ হাজার কর্মী যেতে না পারার ধারণা সঠিক নয়। যারা ছাড়পত্র পেয়েছেন, তাদের মধ্যে কত হাজার যেতে পারেননি, তাও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
জনশক্তি ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, ২০২২ সালের ৮ আগস্ট থেকে গতকাল পর্যন্ত ৪ লাখ ৭০ হাজার কর্মী মালয়েশিয়া গেছেন। ছাড়পত্র পেয়েও ২৩ হাজারের বেশি কর্মী নানা কারণে দেশটিতে যাননি। টিকিট সংকটে যেতে না পারা কর্মীর সংখ্যা ১০ হাজার হতে পারে।
গত ২৮ মে প্রবাসীকল্যাণ সচিব রুহুল আমিন জানিয়েছিলেন, ওইদিন পর্যন্ত ৪ লাখ ৬০ হাজার কর্মী গেছেন মালয়েশিয়ায়। বিএমইটি মহাপরিচালক সালেহ আহমদ মোজাফফরের বক্তব্য জানতে পারেনি । প্রবাসীকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান গতকাল দেশে ফিরে জানান, কত কর্মী যেতে পারেননি, তালিকা চাওয়া হয়েছিল। বায়রা দিতে পারেনি।
গতকাল পর্যন্ত এ সংখ্যা কত, তা জানাতে পারেননি বায়রা মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী। তিনি বলেছেন, ৪ মে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকের সময়ে ৩০ হাজারের মতো কর্মী যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। এরপর যেভাবে বিশেষ ফ্লাইট কুয়ালালামপুর গেছে, তাতে খুব বেশি কর্মী পড়ে থাকার কথা নয়। শুক্রবারও ঢাকা-কুয়ালালামপুরে আটটি ফ্লাইট ছিল। এতে ২ হাজার ৩০০ কর্মী যেতে পেরেছেন। তাদের অনেকে ভারত, দুবাই, চীন, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া ঘুরে দেশটিতে গেছেন। গত বৃহস্পতিবার সরকারিভাবে সাড়ে ৪ হাজার ও আগের দিন গেছে ৫ হাজার কর্মী।
শেষ সময়েও ছাড়পত্র: উড়োজাহাজের টিকিট সংকটে কর্মীরা নির্ধারিত সময়ে মালয়েশিয়া যেতে পারবেন কিনা-অনিশ্চয়তা থাকার পরও গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রণালয় নিয়োগ অনুমতি এবং ছাড়পত্র দিয়েছে বিএমইটি। আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, যেসব কর্মীর ভিসার বিপরীতে টিকিট নিশ্চিত হয়েছে, তাদেরই নিয়োগ অনুমতি ও ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।
গত বুধবার একই দিনে চার কর্মীর নিয়োগ অনুমতি এবং ছাড়পত্র পায় কমফোর্ট ওভারসিজ কনসালট্যান্ট (নিবন্ধন নম্বর-১৭৩৯)। প্রতিষ্ঠানটির মালিক মেহেদী হাসান বলেন, বৃহস্পতিবার চারজনকে ইউএস বাংলার ফ্লাইটে তুলে দিয়েছি। প্রতি টিকিটের দাম পড়েছে ১ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। যতদূর বুঝতে পারছি, ১০ থেকে ১৫ হাজার কর্মী যেতে পারবেন না।
বুধবার নিয়োগ অনুমতি এবং ছাড়পত্র পায় আল হেরা ওভারসিজের (নিবন্ধন নম্বর- ১৫৩০) ২০ কর্মী। তবে তারা যেতে পেরেছেন কিনা, তা নিশ্চিত নন প্রতিষ্ঠানটির মালিক রাশেদ জামান। তিনি বলেছেন, ‘এসব অন্য এজেন্সির কর্মী। আমাদের নামে ছাড়পত্র করে দিয়েছি। যেতে পেরেছে কিনা, তা ওই এজেন্সি বলতে পারবে।’
২০১৫ সালে ১০ বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগ হয়। সেবার প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সমঝোতা স্মারক সইয়ের পর ২৫ বাংলাদেশি এজেন্সিকে বাছাই করে মালয় সরকার। এগুলোও সিন্ডিকেট নামে পরিচিত। পরে আরও ৭৫ বেসরকারি এবং একটি সরকারি এজেন্সিকে কর্মী পাঠানোর কাজ দেয় মালয়েশিয়া।
বেসরকারি এজেন্সি কর্মীপ্রতি সাড়ে ৪ থেকে সাড়ে ৬ লাখ টাকা নিয়েছে। প্রত্যেক কর্মীর জন্য সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রকরা নেয় ১ লাখ ৪২ হাজার টাকা করে। দেড় লাখ টাকায় ভিসা ‘কিনে’ ভুয়া চাকরি দেখিয়েও কর্মী পাঠানো হয়েছে। ফলে মালয়েশিয়া গিয়ে কর্মীরা চাকরি পাননি। অনুসন্ধান অনুযায়ী, সিন্ডিকেটের চাঁদা এবং ভিসা কেনা বাবদ প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি হয়েছে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠিয়ে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগে দুর্নীতির কথা জানিয়েছে।
এদিকে জাতিসংঘের কাছে বিদেশি শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে মালয়েশিয়া। গত ২৮ মার্চ বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের প্রতারণামূলক নিয়োগের অভিযোগে মালয়েশিয়ার সরকারকে চিঠি দিয়েছিল জাতিসংঘ। দেশটির কর্তৃপক্ষ সেই চিঠির জবাবে ওই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। শুক্রবার ফ্রি মালয়েশিয়া টুডের প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়।
সংকট জেনেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি: গত ২১ মার্চ মালয়েশিয়া সরকার জানিয়েছিল, ৩১ মের পর বিদেশি কর্মী নিয়োগ করা হবে না। ২১ এপ্রিল পর্যন্ত চাহিদাপত্র দেয়। তখনই জানা ছিল, ৩১ মে পর্যন্ত কত কর্মী যেতে পারেন। কিন্তু তাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেনি প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে ফ্লাইট বৃদ্ধির অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত এই পরিবহন সংস্থাটি জানিয়ে দেয়, হজের কারণে মালয়েশিয়ার জন্য দিনে চারটির বেশি ফ্লাইট পরিচালনা সম্ভব নয়। বিদেশি কিংবা বেসরকারি উড়োজাহাজ সংস্থার বাড়তি ফ্লাইটের ব্যবস্থা করতে পারেনি প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়।
ফেনীর মাজেদুল ইসলাম জানিয়েছেন, বিএমইটি ছাড়পত্র থাকার পরও মালয়েশিয়া যেতে পারেননি তিনি। প্রথমে দালালকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা দেন। ফ্লাইট ভাড়া বেড়ে গেছে অজুহাতে দালাল ঘুরাচ্ছিল। পরে গত ২৫ মে সুদের ওপর ঋণ করে দেন আরও ৬০ হাজার টাকা। এরপরও টিকিটের অভাবে মাজেদুল মালয়েশিয়া যেতে পারলেন না। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ঋণ দেব কীভাবে? আমার জীবন চলবে কীভাবে?
জনশক্তি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আবার মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুলতে বছরখানেক সময় লাগবে। ফলে যারা টাকা-পয়সা দিয়েও যেতে পারেননি, আপাতত আহাজারি করেও তাদের কোনো লাভ হবে না।