ঢাকা , সোমবার, ২৪ মার্চ ২০২৫, ১০ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যেসব কারণে নিষিদ্ধ হলো ছাত্রলীগ

অনলাইন নিউজ ডেস্ক
  • আপডেটঃ ১১:৫৫:৫৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৪
  • / ৬১২ বার পঠিত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির দাবির মুখে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এখন ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ সত্তা হিসেবে তালিকাভুক্ত হলো।

 

গতকাল বুধবার (২৩ অক্টোবর) রাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) পর্যন্ত সরকারকে সময় বেঁধে দিয়েছিল।

 

এদিকে সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাৎক্ষণিক আনন্দ মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা।

 

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, গত ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে হত্যা, নির্যাতন, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণরুমকেন্দ্রিক নিপীড়ন, ছাত্রাবাসে সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ, যৌন নিপীড়নসহ জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী নানা কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল ছাত্রলীগ। এসবের প্রমাণ দেশের সব গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। কিছু সন্ত্রাসী ঘটনায় সংগঠনটির নেতাকর্মীর অপরাধ আদালতেও প্রমাণ হয়েছে।

 

প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, গত ১৫ জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সাধারণ ছাত্রছাত্রী ও জনগণের ওপর আক্রমণ করে শত শত নিরপরাধ শিক্ষার্থী ও ব্যক্তিকে হত্যা করেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা; অসংখ্য মানুষের জীবন বিপন্ন করেছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও ছাত্রলীগ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক, ধ্বংসাত্মক, উস্কানিমূলক ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। সরকারের কাছে এসব কর্মকাণ্ডের যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার।

 

রাষ্ট্রপতির আদেশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন নামাঙ্কিত মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের রাজনৈতিক শাখা-২-এর জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯-এর ধারা ১৮-এর উপধারা (১)-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। এ আইনের তপশিল-২-এ বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নামের ছাত্র সংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্তা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হলো।

 

আইনের ১৯ ধারা অনুযায়ী, নি‌ষিদ্ধের সিদ্ধান্ত পুন‌র্বিবেচনার আ‌বেদ‌নে ৩০ দিন সময় পা‌বে ছাত্রলীগ। আ‌বেদন কর‌লে সরকার তা ৯০ দি‌নের ম‌ধ্যে নিষ্প‌ত্তি কর‌বে। নি‌ষি‌দ্ধের সিদ্ধান্ত বহাল থাক‌লে ৩০ দি‌নের ম‌ধ্যে হাই‌কো‌র্টে আ‌পি‌লের সু‌যোগ পা‌বে সংগঠনটি।

 

সন্ত্রাসবি‌রোধী আইনের ২০.১(ঙ) ধারায় বলা হ‌য়ে‌ছে, ‘নিষিদ্ধ সত্তা কর্তৃক বা উহার পক্ষে বা সমর্থনে যে কোনো প্রেস বিবৃতির প্রকাশনা, মুদ্রণ বা প্রচারণা, সংবাদ সম্মেলন বা জনসম্মুখে বক্তৃতা প্রদান নিষিদ্ধ।’

 

সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন, এর আগের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনসহ বহু ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রলীগের ছাত্রবিরোধী অবস্থানের কারণে অনেকবার সংগঠনটি নিষিদ্ধের দাবি উঠেছিল।

 

এদিকে বুধবার (২৩ অক্টোবর) রাত সোয়া ৮টায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে লেখেন, ‘আজকে রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। আজ রাত সাড়ে ৮টায় ভিসির বাসভবনের ফটকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অবস্থান কর্মসূচি শুরু হয়।’

 

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সমালোচিত ছিল ছাত্রলীগ

 

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাঙালির স্বাধিকারের বিভিন্ন আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে ছাত্রলীগ। তবে সময়ের পরিক্রমায় ছাত্রলীগ একাধিক ধারায় বিভক্ত হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিজেদের মধ্যে দলাদলি, অন্তঃকোন্দল, হামলা-মারামারি, খুন, শিক্ষার্থী নির্যাতন, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিসহ নানা কারণে ছাত্রলীগের সমালোচনা হয়েছে।

 

চাঁদাবাজির অভিযোগে ২০১৯ সালে সমালোচনার মুখে ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী (শোভন) ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর দিবাগত রাতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শেরেবাংলা হলে ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করেন শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে। বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন আবরার। পরে ওই হত্যা মামলায় ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড আর ৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেন আদালত।

 

২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক এলাকায় দরজি দোকানের কর্মচারী বিশ্বজিৎ দাসকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় বেশ কয়েকজন মৃত্যুদণ্ড এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পান। একই বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমেদকে হত্যা করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

 

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ২০১৮ সালে আন্দোলন শুরু হলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। একই দাবিতে ২০২৪ সালে আবার আন্দোলন শুরু হলে গত ১৫ জুলাই শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ওই দিনই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ক্যাম্পাসে যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ হয়েছে, তার জবাব দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগ প্রস্তুত। তবে ১৬ জুলাই রাতে এবং পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বের করে দেন শিক্ষার্থীরা। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তাদের বের করে দেওয়া হয়।

 

২০২২ সাল থেকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন সাদ্দাম হোসেন। সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ (ইনান)। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে আত্মগোপনে চলে যান ছাত্রলীগের নেতারা। তবে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার পর রাতে ছাত্রলীগের প্যাডে তাঁদের স্বাক্ষরে একটি বিবৃতি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। বিবৃতিতে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক বলে উল্লেখ করা হয়।

 

যে দাবির মুখে নিষিদ্ধ হলো:

 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার দাবি জানিয়ে আসছিল। গত মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তাদের ঘোষিত পাঁচ দফা দাবির দ্বিতীয়টি ছিল ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে এই সপ্তাহের মধ্যে আজীবন নিষিদ্ধ করতে হবে। এরই মধ্যে বুধবার (২৩ অক্টোবর) সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। সেখান থেকে ছাত্রলীগকে বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) মধ্যে নিষিদ্ধ করার সময় বেঁধে দেওয়া হয়।

 

এই সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসন বাংলাদেশে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। গত ১৬ বছর ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রলীগ যে ধরনের নৃশংসতা চালিয়েছে ও হলগুলোকে যেভাবে নির্যাতনকেন্দ্র বানিয়েছে, সেখানে তাদের ন্যূনতম পুনর্বাসনের সুযোগ নেই। একটি জঙ্গি সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার জন্য যত ধরনের উপাদান প্রয়োজন, সব কটিই ছাত্রলীগের রয়েছে।

 

এদিকে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়ার খবরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে মিছিল করা হয়েছে।

অর্থআদালতডটকম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া অন্য কোথাও ব্যবহার করা যাবে না।

error: Content is protected !!

যেসব কারণে নিষিদ্ধ হলো ছাত্রলীগ

আপডেটঃ ১১:৫৫:৫৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৪

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির দাবির মুখে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এখন ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ সত্তা হিসেবে তালিকাভুক্ত হলো।

 

গতকাল বুধবার (২৩ অক্টোবর) রাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) পর্যন্ত সরকারকে সময় বেঁধে দিয়েছিল।

 

এদিকে সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাৎক্ষণিক আনন্দ মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা।

 

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, গত ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে হত্যা, নির্যাতন, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণরুমকেন্দ্রিক নিপীড়ন, ছাত্রাবাসে সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ, যৌন নিপীড়নসহ জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী নানা কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল ছাত্রলীগ। এসবের প্রমাণ দেশের সব গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। কিছু সন্ত্রাসী ঘটনায় সংগঠনটির নেতাকর্মীর অপরাধ আদালতেও প্রমাণ হয়েছে।

 

প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, গত ১৫ জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সাধারণ ছাত্রছাত্রী ও জনগণের ওপর আক্রমণ করে শত শত নিরপরাধ শিক্ষার্থী ও ব্যক্তিকে হত্যা করেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা; অসংখ্য মানুষের জীবন বিপন্ন করেছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও ছাত্রলীগ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক, ধ্বংসাত্মক, উস্কানিমূলক ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। সরকারের কাছে এসব কর্মকাণ্ডের যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার।

 

রাষ্ট্রপতির আদেশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন নামাঙ্কিত মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের রাজনৈতিক শাখা-২-এর জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯-এর ধারা ১৮-এর উপধারা (১)-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। এ আইনের তপশিল-২-এ বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নামের ছাত্র সংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্তা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হলো।

 

আইনের ১৯ ধারা অনুযায়ী, নি‌ষিদ্ধের সিদ্ধান্ত পুন‌র্বিবেচনার আ‌বেদ‌নে ৩০ দিন সময় পা‌বে ছাত্রলীগ। আ‌বেদন কর‌লে সরকার তা ৯০ দি‌নের ম‌ধ্যে নিষ্প‌ত্তি কর‌বে। নি‌ষি‌দ্ধের সিদ্ধান্ত বহাল থাক‌লে ৩০ দি‌নের ম‌ধ্যে হাই‌কো‌র্টে আ‌পি‌লের সু‌যোগ পা‌বে সংগঠনটি।

 

সন্ত্রাসবি‌রোধী আইনের ২০.১(ঙ) ধারায় বলা হ‌য়ে‌ছে, ‘নিষিদ্ধ সত্তা কর্তৃক বা উহার পক্ষে বা সমর্থনে যে কোনো প্রেস বিবৃতির প্রকাশনা, মুদ্রণ বা প্রচারণা, সংবাদ সম্মেলন বা জনসম্মুখে বক্তৃতা প্রদান নিষিদ্ধ।’

 

সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন, এর আগের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনসহ বহু ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রলীগের ছাত্রবিরোধী অবস্থানের কারণে অনেকবার সংগঠনটি নিষিদ্ধের দাবি উঠেছিল।

 

এদিকে বুধবার (২৩ অক্টোবর) রাত সোয়া ৮টায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে লেখেন, ‘আজকে রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। আজ রাত সাড়ে ৮টায় ভিসির বাসভবনের ফটকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অবস্থান কর্মসূচি শুরু হয়।’

 

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সমালোচিত ছিল ছাত্রলীগ

 

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাঙালির স্বাধিকারের বিভিন্ন আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে ছাত্রলীগ। তবে সময়ের পরিক্রমায় ছাত্রলীগ একাধিক ধারায় বিভক্ত হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিজেদের মধ্যে দলাদলি, অন্তঃকোন্দল, হামলা-মারামারি, খুন, শিক্ষার্থী নির্যাতন, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিসহ নানা কারণে ছাত্রলীগের সমালোচনা হয়েছে।

 

চাঁদাবাজির অভিযোগে ২০১৯ সালে সমালোচনার মুখে ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী (শোভন) ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর দিবাগত রাতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শেরেবাংলা হলে ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করেন শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে। বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন আবরার। পরে ওই হত্যা মামলায় ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড আর ৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেন আদালত।

 

২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক এলাকায় দরজি দোকানের কর্মচারী বিশ্বজিৎ দাসকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় বেশ কয়েকজন মৃত্যুদণ্ড এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পান। একই বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমেদকে হত্যা করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

 

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ২০১৮ সালে আন্দোলন শুরু হলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। একই দাবিতে ২০২৪ সালে আবার আন্দোলন শুরু হলে গত ১৫ জুলাই শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ওই দিনই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ক্যাম্পাসে যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ হয়েছে, তার জবাব দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগ প্রস্তুত। তবে ১৬ জুলাই রাতে এবং পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বের করে দেন শিক্ষার্থীরা। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তাদের বের করে দেওয়া হয়।

 

২০২২ সাল থেকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন সাদ্দাম হোসেন। সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ (ইনান)। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে আত্মগোপনে চলে যান ছাত্রলীগের নেতারা। তবে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার পর রাতে ছাত্রলীগের প্যাডে তাঁদের স্বাক্ষরে একটি বিবৃতি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। বিবৃতিতে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক বলে উল্লেখ করা হয়।

 

যে দাবির মুখে নিষিদ্ধ হলো:

 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার দাবি জানিয়ে আসছিল। গত মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তাদের ঘোষিত পাঁচ দফা দাবির দ্বিতীয়টি ছিল ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে এই সপ্তাহের মধ্যে আজীবন নিষিদ্ধ করতে হবে। এরই মধ্যে বুধবার (২৩ অক্টোবর) সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। সেখান থেকে ছাত্রলীগকে বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) মধ্যে নিষিদ্ধ করার সময় বেঁধে দেওয়া হয়।

 

এই সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসন বাংলাদেশে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। গত ১৬ বছর ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রলীগ যে ধরনের নৃশংসতা চালিয়েছে ও হলগুলোকে যেভাবে নির্যাতনকেন্দ্র বানিয়েছে, সেখানে তাদের ন্যূনতম পুনর্বাসনের সুযোগ নেই। একটি জঙ্গি সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার জন্য যত ধরনের উপাদান প্রয়োজন, সব কটিই ছাত্রলীগের রয়েছে।

 

এদিকে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়ার খবরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে মিছিল করা হয়েছে।